Wednesday, June 28, 2017

তাবিজাত কি নাযায়েজ এবং শিরক?

সহিহ মুসলিমের 'চিকিৎসা' অধ্যায়ের একটি পরিচ্ছেদের শিরোনাম হচ্ছে, 'মুআওয়িযাত পড়ে অসুস্থ ব্যক্তিকে ফুঁ দেওয়া'। সেখানে হযরত আয়িশা রাযি. থেকে বর্ণনা এসেছে যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন তাঁর পরিবারের কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তেন, তিনি 'মুআওয়িযাত' পড়ে রোগীর ওপর ফুঁ দিতেন। আর মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে যখন তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, আমি তখন 'মুআওয়িযাত' পড়ে তাঁর ওপর ফুঁ দিয়েছিলাম এবং তাঁর নিজের হাত দিয়ে শরীর মুছে দিতাম; কেননা তাঁর হাত আমার হাতের চেয়ে অধিকতর বরকতময়। (সহিহ মুসলিম: ৫৬৭৮)  'মুআওয়িযাত' মানে সূরা আল ফালাক এবং সূরা আন নাস। কারো মতে এদুটোর সঙ্গে সূরা আল ইখলাসও শামিল। কেননা সহিহ বুখারিতে বর্ণনা রয়েছে যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতিরাত্রে যখন বিছানায় গমন করতেন, তখন নিজের উভয় হাতের তালু একত্রিত করে ফুঁ দিতেন এবং ইখলাস, ফালাক ও নাস এই তিনটি সূরা পড়তেন। (সহিহ বুখারি: ৪৭৩০)
মোটকথা, মুসলিম শরিফের হাদিস থেকে প্রতিভাত হচ্ছে, অসুস্থ ব্যক্তির জন্য ঝাড়ফুঁক করা, কোনো কিছু পড়ে ফুঁ দেওয়া জায়েয। তবে হাদিসবিদগণ বলেন, এটা জায়েয হওয়ার জন্য শর্ত হলো, তা স্পষ্ট ও বোধগম্য হতে হবে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে না এবং এগুলো স্বয়ংক্রিয় কার্যকরী হওয়ার বিশ্বাস না রাখা। এসব শর্ত বিদ্যমান থাকলে ঝাড়ফুঁক করতে অসুবিধা নেই। ( সহিহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তাকমিলায়ে ফাতহুল মুলহিম; তাকি উসমানি, ৪/২৭৬)
ঝাড়ফুঁকের ক্ষেত্রে প্রধান বিষয় হলো, কুরআনে কারিমের কোনো আয়াত কিংবা আল্লাহ তাআলার কোনো নাম বা সিফাত পাঠ করে অসুস্থ ব্যক্তির উপর ফুঁ দেওয়া। আর এ কর্মপন্থা নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একাধিক হাদিসে বিবৃত হয়েছে। অবশ্য তাবিজাত লিখা এবং ছোট্ট শিশু ও রোগীদের গলায় লটকানো কিংবা তাবিজাত লিখে রোগীকে সেটার পানি পান করানো; এমন কর্মপদ্ধতিও অনেক সাহাবি ও তাবিয়ি থেকে প্রমাণিত আছে।
আমর ইবনে শুআইবের সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমাদের কেউ যদি ঘুমে ভয় পায় সে যেন এই দুআটি পড়ে নেয়: 'আউযু বি কালিমাতিল্লাহিত তাম্মাত মিন গাজাবিহি ওয়া সূয়ি ইকাবিহি, ওয়া মিন শার্রি ইবাদিহি, ওয়া মিন শার্রিশ শায়াতিন ওয়া আন ইয়াহজুরুন। ' তো আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস রাযি. স্বীয় সন্তানদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক তাদের এই দুআ শেখাতেন আর যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক; দুআটি লিখে তাদের গলায় লটকিয়ে দিতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা: ২৩৯৯৮)
আবু ইসমাহ থেকে বর্ণিত, সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব রাহ.কে আমি তাবিজ সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে তিনি বললেন, চামড়ায় তা লিখা হলে কোনো সমস্যা নেই। (প্রাগুক্ত: ২৩৯৯৪)
মাসিক ঋতুবতী নারীর শরীরে দেওয়া তাবিজ সম্পর্কে আতা ইবনে আবি রাবাহ রাহ. বলেন, যদি তা চামড়ায় লিখা থাকে তবে সে যেন তা খুলে ফেলে। আর যদি তা রূপার নলে লিখা থাকে, তবে তার ইচ্ছা। ইচ্ছে করলে শরীরে রেখে দেবে আর না হয় রাখবে না। (প্রাগুক্ত: ২৩৯৯৫)
মুজাহিদ রাহ. থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি লোকদের তাবিজ লিখে দিতেন এবং তাদের গলায় লটকাতেন। (প্রাগুক্ত: ২৩৯৯৬)
হাদিস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য এই বিশাল ভাণ্ডার মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বায় আবু জা'ফর, মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন, উবায়দুল্লাহ ইবনে আবদুল্লাহ ইবনে উমার, জাহহাক প্রমুখ থেকে উদ্ধৃত বর্ণনাসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, তাঁরা সবাই তাবিজ লিখা, লটকানো কিংবা বাহু ইত্যাদিতে বেঁধে রাখা বৈধ বলে মত পোষণ করতেন। (দেখুন: ২৩৯৯৯-২৪০০৩)
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রাহ. (মৃ. ৭২৮ হি.) লিখেছেন, “অসুস্থ ও অন্যান্য বিপদগ্রস্থদের জন্য আল্লাহর জিকর ও কুরআন থেকে বৈধ কালি দ্বারা তাবিজ লিখা, তা পান করা এবং তা দিয়ে গোসল করা সবটিই জায়েয। এমনিভাবে মত পোষণ করেছেন ইমাম আহমদ রাহ. ও অন্যান্য ইমাম। ইমাম আহমাদ রাহ.'র পুত্র আবদুল্লাহ বলেন, আমি স্বীয় পিতার নিকট পড়েছি, তিনি বর্ণনা করেছেন ইয়া'লা ইবনে উবায়দ থেকে, তিনি সুফিয়ান থেকে, তিনি মুহাম্মাদ ইবনে আবি লায়লা থেকে, তিনি হিকাম থেকে, তিনি সাঈদ ইবনে জুবায়র থেকে, তিনি সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে, তিনি বলেন যে, কোনো মহিলার জন্য সন্তানপ্রসব কষ্টকর হয়ে গেলে এটা যেন লিখে দেয়া হয়: বিসমিল্লাহি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল হালিমুল কারিম, সুবহানাল্লাহি রাব্বিল আরশিল আজিম, আলহামদুলিল্লাহ রাব্বিল আলামিন, সূরা আন নাযিআত-এর শেষ আয়াত এবং সূরা আল আহকাফ-এর ৩৫ নং আয়াত। আব্বা (ইমাম আহমাদ) বলেন, আসওয়াদ ইবনে আমিরও স্বীয় সূত্রে এ মর্মে বর্ণনা পেশ করেছেন। তিনি বলেন, একটা পরিচ্ছন্ন পাত্রে তা লিখে পান করানো হবে। আব্বা বলেন, ওয়াকি' রাহ. আরও বর্ধিত করেছেন, তাঁর মতে মহিলাকে ওই পানি পান করানো হবে এবং তার নাভির নিচে পানি ছিটানো হবে। আবদুল্লাহ বলেন, আমার আব্বা (ইমাম আহমাদ)-কে মহিলার জন্য পাত্র কিংবা পরিচ্ছন্ন অন্য কিছুতে তাবিজ লিখে দিতে আমি দেখেছি।
এরপর ইবনে তাইমিয়া রাহ. ভিন্ন সূত্রে ইবনে আব্বাস রাযি.'র উপরিউক্ত বর্ণনাটি পুনরায় উল্লেখ করেছেন। এর শেষদিকে আছে, বর্ণনাকারী আলি ইবনে হাসান ইবনে শাকিক বলেন, দুআটি কাগজে লিখে মহিলার বাহুতে লটকানো হবে। আলি বলেন, বারংবার এমনটা করে আমাদের অভিজ্ঞতা রয়েছে; এরচেয়ে ভালো কোনো ব্যবস্থা আমরা দেখিনি। তো সন্তান প্রসব হয়ে গেলে মহিলা তাবিজটি দ্রুত খুলে ফেলবেন এবং কোনো তেনায় পেঁচিয়ে রাখবেন অথবা জ্বালিয়ে ফেলবেন। (বিস্তারিত দেখুন: মাজমূউল ফাতাওয়া, ১৯/৬৪-৬৫)
এসকল উদ্ধৃতি আমাদের সময়ের ওইসব লোকের বিরুদ্ধে প্রমাণ; যারা তাবিজ লিখা, তাবিজ ভেজানো পানি পান করা কিংবা তাবিজ লটকানো শরয়ি দৃষ্টিকোণ থেকে নিষিদ্ধ বলে দাবি করেন। তাদের কেউ কেউ বাড়াবাড়ি করতে করতে এই দাবিও করেন যে, এটা শিরক! এ ক্ষেত্রে তারা ইবনে মাসউদ রাযি.’র স্ত্রী জয়নবের সূত্রে বর্ণিত সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি.'র এ হাদিসটি দলিল হিসেবে পেশ করে থাকেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ঝাড়ফুঁক, তাবিজাত এবং ডোরা সুতা বাঁধা শিরক। (সুনানে আবু দাউদ: ৩৮৮৩) কিন্তু দলিল হিসেবে পেশকৃত এ হাদিসেরই শেষাংশ তাদের খণ্ডন করছে। "জয়নব বলেন, আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এমনটা কেন বলছেন? আল্লাহর শপথ! একসময় আমার চোখ সমস্যা হতো, আমি অমুক ইহুদির নিকট যেতাম; সে আমাকে ঝাড়ফুঁক করে দিত। তার ঝাড়ফুঁকের পর চোখ ঠিক হয়ে যেত। প্রতিউত্তরে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ বললেন, এটা মূলত শয়তানের কর্ম, যা সে ওর হাত দিয়ে করাত। তোমার জন্য এভাবে বলাই যথেষ্ট, যেভাবে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, 'আজহিবিল বা'স, রাব্বান নাস' প্রভৃতি। "
এ বর্ণনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, হাদিসে নিষিদ্ধ ঝাড়ফুঁক বলে মুশরিকদের ঝাড়ফুঁকই বোঝানো হয়েছে; যেখানে তারা শয়তান ইত্যাদির আশ্রয় গ্রহণ করত। সুতরাং যে ঝাড়ফুঁক এসব থেকে মুক্ত তা বৈধ হতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রচুর হাদিসের দ্বারা প্রমাণিত। একই অবস্থা তাবিজাতেরও। মুহাদ্দিস আল্লামা শাওকানি রাহ. (মৃ. ১২৫৫ হি.) লিখেছেন, “রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ তিনটি বস্তকে এজন্যেই শিরক বলেছিলেন যে, মানুষ এগুলোকে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয় মনে করতো। ” (নায়লুল আওতার, ৯/১০৪)
এসব আলোচনার সারকথা হলো, কেউ যদি বৈধ কালি দিয়ে কুরআন, আল্লাহর নাম ইত্যাদি দ্বারা তাবিজ লিখে এবং তাকে স্বয়ংক্রিয় মনে না করে; বরং আল্লাহর ওপর আস্থা রেখে এটাকে শুধু একটা মাধ্যম স্বরুপ ব্যবহার করে তবে তা শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়। বরং শাওকানি রাহ.'র উদ্ধৃত সালাফে সালিহিনের কোনো মন্তব্য থেকে এমন তাবিজাত উত্তম বলে সাব্যস্ত হয়; যদি তা হয় কুরআন-হাদিস অনুযায়ী।

শেয়ার করুন

0 Comments:

একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!