ইসলাম পূর্ণাঙ্গ একটি ধর্ম, সুরা মায়িদার তিন নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা সে কথা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, 'আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামতও পূর্ণ করে দিলাম, আর তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে পছন্দ করলাম। '
তাই ইসলামের সব বিষয়ে নির্দিষ্ট হুকুম রয়েছে। অন্য বিষয়গুলোর মতো পুরুষ-মহিলার নামাজের পদ্ধতিগত পার্থক্যের বিষয়টিও এর ব্যত্যয় নয়। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জামানা থেকে সবাই এ পার্থক্য মেনে তদনুযায়ী নামাজ আদায় করতেন। বরং ঐকমত্যে পার্থক্যের বিপরীতে নতুন পদ্ধতি সামনে এলে তা নিঃসংকোচে মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন, যাতে মানুষ ধোঁকায় না পড়ে। যেমন- ইমাম বুখারী (রহ.) 'তারীখে সগীর'-এ উম্মে দারদা (রা.)-এর ঘটনা বর্ণনা করেন যে, 'তিনি নামাজে পুরুষদের মতো বসতেন। ' কিন্তু বর্তমান জামানায় ঐকমত্য সে বিষয়টি নিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত নীতির গবেষকগণ মতানৈক্য দাঁড় করিয়েছেন। তাই নারী-পুরুষের নামাজের পার্থক্যের বিষয়ে দালিলিক আলোচনা উম্মতের সামনে পেশ করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
মূলকথা হলো, পুরুষ-মহিলার মাঝে মৌলিক যে তিনটি পার্থক্য করা হয় তার মধ্যে অন্যতম অবস্থান ও কর্মস্থলের পার্থক্য। পুরুষের কর্মস্থল বাইরে আর নারী গোপনীয় জিনিস।
আর এই মৌলিক পার্থক্যের কারণে মূলত মহিলার নামাজ পুরুষ থেকে ভিন্ন রাখা হয়েছে। নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর জামানা থেকে সাহাবা, তাবেঈন ও তাবে তাবেঈনগণ বিষয়টি খুব সহজভাবে উপলব্ধি করেছেন এবং নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কর্তৃকও নির্দেশিত মহিলাদের নামাজের পার্থক্য অকপটে মেনে নিয়েছেন। এমনকি ইমাম চতুষ্টয় এই পার্থক্যের ব্যাপারে একমত। বাইহাকী (রহ.) বিষয়টি সুনানে কুবরায় এভাবে ব্যক্ত করেছেন যে নামাজের বিভিন্ন বিধানের ক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলার নামাজে পদ্ধতিগত ভিন্নতার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো 'সতর', অর্থাৎ মহিলার জন্য শরিয়তের হুকুম হলো ওই পদ্ধতি অবলম্বন করা, যা তাকে সর্বাধিক পর্দা দান করে। (সুনানে কুবরা)
মৌলিকভাবে মহিলার নামাজে পুরুষ থেকে চার ক্ষেত্রে পার্থক্য রয়েছে :
১. তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত ওঠানো
২. হাত বাঁধার স্থান
৩. রুকুতে সামান্য ঝোঁকা
৪. সিজদা জড়সড় হয়ে করা
৫. বৈঠকে পার্থক্য।
প্রথম পার্থক্য : তাকবিরে তাহরিমার সময় হাত ওঠানো।
১. 'ওয়ায়েল ইবনে হুজুর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট এলাম, তিনি আমাকে বললেন : হে ওয়ায়েল ইবনে হুজুর! যখন তুমি নামাজ পড়বে তখন তুমি তোমার হাত কান পর্যন্ত ওঠাবে আর মহিলারা তাদের হাত বুকের ওপর বাঁধবে।
হাইসামী (রহ.) বলেন, 'এই হাদিসের সমস্ত রাবী নির্ভরযোগ্য, উম্মে ইয়াহইয়া ব্যতীত। কিন্তু পরবর্তী মুহাদ্দিসগণের নিকট উম্মে ইয়াহইয়াও প্রসিদ্ধ।
২. 'ইমাম যুহরী (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহিলারা কাঁধ পর্যন্ত হাত ওঠাবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/২৭০)
দ্বিতীয় পার্থক্য : হাত বাঁধা।
ইমাম তহাবী (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : মহিলারা তাদের উভয় হাতকে বুকের ওপর রেখে দেবে, আর এটাই তাদের জন্য যথোপযুক্ত সতর। (আসসিআয়া : ২/১৫৬, ফাতাওয়ায়ে শামী : ১/৫০৪, আল মাবসুত সারাখসী : ১/২৫)
তৃতীয় পার্থক্য : রুকুতে কম ঝোঁকা।
'যখন মহিলা রুকুতে যাবে তখন হাতদ্বয় পেটের দিকে উঠিয়ে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে, আর যখন সিজদা করবে তখন হাতদ্বয় শরীরের সাথে এবং পেট ও সিনাকে রানের সাথে মিলিয়ে দেবে এবং যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে।
চতুর্থ পার্থক্য : সিজদা জড়সড় হয়ে করা।
'বিখ্যাত তাবেঈ ইয়াযীদ ইবনে আবী হাবীব বলেন, একবার নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নামাজরত দুই মহিলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন তাদেরকে (সংশোধনের উদ্দেশ্যে) বললেন, যখন সিজদা করবে তখন শরীর জমিনের সাথে মিশিয়ে দেবে। কেননা মহিলারা এ ক্ষেত্রে পুরুষদের মতো নয়। ' (কিতাবুল মারাসীল ইমাম আবু দাউদ হা. নং ৮০)
আবু দাউদ (রহ.)-এর উক্ত হাদিস সম্পর্কে গায়েবে মুকাল্লিদদের বিখ্যাত আলেম ও মুহাদ্দিস নওয়াব সিদ্দীক হাসান খান 'আউনুল বারী' ১/৫২০-এ লিখেছেন, এই মুরসাল হাদিসটি সকল ইমামের উসুল ও মূলনীতি অনুযায়ী দলিল হওয়ার যোগ্য।
'হজরত মুজাহিদ ইবনে জাবর (রহ.) পুরুষদের জন্য মহিলাদের মতো ঊরুর সাথে পেট লাগিয়ে সিজদা করাকে অপছন্দ করতেন। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০৩)
'হজরত হাসান বসরী ও কাতাদাহ (রহ.) বলেন, মহিলা যখন সিজদা করবে তখন সে যথাসম্ভব জড়সড় হয়ে থাকবে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফাঁকা রেখে সিজদা করবে না, যাতে কোমর উঁচু হয়ে থাকে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০৩)
পঞ্চম পার্থক্য : বৈঠকের ক্ষেত্রে মহিলাগণ উভয় পা বাঁ পাশ দিয়ে বের করে দিয়ে জমিনের ওপর নিতম্ব রেখে ঊরুর সাথে পেট মিলিয়ে রাখবে।
'হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, মহিলা যখন নামাজের মধ্যে বসবে তখন যেন এক ঊরু (ডান ঊরু) আরেক ঊরুর ওপর রাখে, আর যখন সিজদা করবে তখন যেন পেট ঊরুর সাথে মিলিয়ে রাখে, যা তার সতরের জন্য অধিক উপযুক্ত হয়। (সুনানে কুবরা বাইহাকী : ২/২২৩)
'হজরত খালেদ ইবনে লাজলাজ (রহ.) বলেন, মহিলাদেরকে আদেশ করা হতো তারা যেন নামাজে দুই পা ডান দিক দিয়ে বের করে নিতম্বের ওপর বসে, পুরুষদের মতো না বসে, আবরণীয় কোনো কিছু প্রকাশ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় মহিলাদেরকে এমনটি করতে হয়। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০৩)
'ইবনে আব্বাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো যে মহিলারা কিভাবে নামাজ আদায় করবে? তিনি বললেন, খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামাজ আদায় করবে। (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা : ১/৩০২)
উপর্যুক্ত সংক্ষিপ্ত আলোচনা একটু মনোযোগের সাথে পাঠ করলে একজন ঠাণ্ডা মস্তিষ্কের পাঠক সহজে অনুমান করতে সক্ষম হবেন যে, মহিলাদের নামাজের পার্থক্যের বিষয়টি নবীজি (সা.) এবং সাহাবীদের যুগ থেকেই চলে আসছে এবং এর পক্ষে অনেক শক্তিশালী দলিল রয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ (?) সালাফ থেকে চলে আসা সুপ্রতিষ্ঠিত মত ও পথকে উপেক্ষা করে নিজের গবেষণালব্ধ মত ও পথকে জনগণের মাঝে চালিয়ে দেওয়ার ও জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তার কিছু নমুনা নিম্নে পেশ করা হলো : আরবের প্রসিদ্ধ গায়রে মুকাল্লিদ শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী তাঁর 'সিফাতুস সালাত' নামক গ্রন্থে দাবি করেন যে পুরুষ-মহিলার নামাজের পদ্ধতি এক ও অভিন্ন এবং তিনি তাঁর এ দাবি হাদিসবিরোধী নয়- এ কথা প্রমাণ করার জন্য প্রথম পর্যায়ে তিনি আহলে হকের পক্ষের মহিলাদের নামাজের পার্থক্য সংবলিত মারাসীলে আবু দাউদের হাদিসটিকে এ কথা বলে যয়ীফ আখ্যা দিলেন যে, 'হাদিসটি মুরসাল, অতএব, তা যয়ীফ' অথচ অধিকাংশ ইমাম বিশেষ করে স্বর্ণযুগের ইমামদের মতে, প্রয়োজনীয় শর্তাবলি বিদ্যমান থাকলে মুরসাল হাদিসও মারফু এবং সহিহ হাদিসের মতো গ্রহণযোগ্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে আবু দাউদ (রহ.)-এর এই হাদিসটির শুদ্ধতার পক্ষে সমস্ত ইমামগণ এমনটি গায়রে মুকাল্লিদ আলেম সিদ্দীক হাসান খান সাহেবও স্বীকারোক্তি দিয়েছেন।
তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বীয় মনগড়া উক্তিকে প্রমাণের জন্য ইবরাহীম নাখয়ী (রহ.)-এর কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি নাকি বলেছেন, 'মহিলাগণ পুরুষদের মতোই নামাজ আদায় করবে'- এই উক্তি উল্লেখ করে মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবার উদ্ধৃতি দিয়েছেন। অথচ এই গ্রন্থের কোথাও এই কথাটি নেই। বরং 'মাকতাবায়ে শামেলার' হাজার হাজার কিতাব সার্চ করেও এই উক্তি খুঁজে পাওয়া যায়নি। দ্বীনের নামে এমন জালিয়াতির কোনো অর্থ হয় না।
তৃতীয় কাজটি এই করলেন যে, উম্মে দারদা (রা.) সম্পর্কে বর্ণিত একটি উক্তি উল্লেখ করেছেন, 'তিনি নামাজে পুরুষদের মতো বসতেন' আলবানী সাহেব যদি এই উক্তি দ্বারা নিজের দাবি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই উক্তি দ্বারা পুরুষ-মহিলার নামাজে পার্থক্যের কথাই প্রমাণিত হয়। কেননা উভয়ের বসার পদ্ধতি এক হয়ে থাকলে 'উম্মে দারদা পুরুষের মতো বসতেন' এ কথা বলার প্রয়োজন কী? যেহেতু উম্মে দারদা মহিলাদের নামাজে বসার প্রচলিত ও সাধারণ নিয়মের উল্টো করে পুরুষদের মতো বসতেন, যা ছিল একটি ব্যতিক্রমী জিনিস। তাই এ কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ কথা বুখারী (রহ.)-এর 'তারীখে সগীরে' স্থান করে নিয়েছে।
এ ছাড়া আহলে হাদিস ভাইয়েরা নিজেদের উদ্ভাসিত আরো কিছু যুক্তি-তর্ক পেশ করে থাকেন, যেগুলোর দুর্বলতা দ্বীনের বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান রাখেন এমন যে কেউ বুঝতে সক্ষম। তাই সেসব বিষয়ে অবতারণা করা হলো না।
আহলে হাদিস ভাইগণ পুরুষ-মহিলাদের অনেক ইবাদতে পার্থক্য মানেন, যেগুলোর ভিত্তি মহিলাদের সতর ঢাকার ওপর। যেমন ইহরাম অবস্থায় পুরুষের জন্য মাথা ঢাকা নিষেধ অথচ মহিলাদের জন্য মাথা ঢেকে রাখা ফরজ। অনুরূপভাবে পুরুষগণ উচ্চ আওয়াজে তালবিয়া পাঠ করে থাকেন অথচ মহিলাদের জন্য নিম্নস্বরে তালবিয়া পড়া জরুরি। এ তো শুধু হজের কথা উল্লেখ করা হলো, এ ছাড়া আরো অনেক ইবাদতে পুরুষ-মহিলার পার্থক্য সবাই মেনে আসছে। তাহলে নামাজের ক্ষেত্রে পুরুষ-মহিলার পার্থক্য মানতে তাদের সমস্যা কোথায়? এই পার্থক্য তো আমাদের মনগড়া কোনো বিষয় নয়। সরাসরি হাদিস ও আশারে সাহাবা থেকে প্রমাণিত। আহলে হাদিস বন্ধুরা একদিকে হাদিস মানার দাবি করছে আবার অন্যদিকে হাদিসের উল্টা কাজ করছে, কী আজব বৈপরীত্য?
মুসলিম সমাজে বিভ্রান্তি ছড়ানো যাদের লক্ষ্য এবং মুসলিমদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা যাদের উদ্দেশ্য, আল্লাহতা'আলা আমাদের তাদের থেকে দূরে থাকার তাওফীক দান করুন।
আমিন। পুরুষদের জামা'আতে মহিলাদের অংশগ্রহণ! শরিয়ত কী বলে?
রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর বর্ণনায় মহিলাদের নামাজের উত্তম স্থান
ক. হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন, মহিলার জন্য নির্ধারিত হুজরার নামাজ অপেক্ষা তার ঘরে নামাজ পড়া উত্তম, আর ঘরে নামাজ অপেক্ষা নিভৃত ও একান্ত কোঠায় নামাজ পড়া উত্তম। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৫৭০)
খ. একদা হজরত উম্মে হুমাইদ (রা.) রাসুল (রা.)-এর দরবারে এসে বললেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমি আপনার সঙ্গে নামাজ পড়তে ভালোবাসি। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, আমি জানি তুমি আমার সঙ্গে নামাজ পড়তে ভালোবাসো, কিন্তু তোমার ঘরে নামাজ তোমার বাইরের হুজরায় নামাজ অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার হুজরায় নামাজ তোমার বাড়িতে নামাজ অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার বাড়িতে নামাজ তোমার মহল্লার মসজিদে নামাজ অপেক্ষা উত্তম। আর তোমার মহল্লার মসজিদে নামাজ আমার মসজিদে নামাজ অপেক্ষা উত্তম। অতঃপর উক্ত মহিলা নিজ ঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে নামাজের স্থান নির্ধারণ করিয়ে নিল এবং আমরণ তাতেই নামাজ আদায় করল। মুসনাদে আহমাদ, সহিহ ইবনে খুযাইমা ও সহীহ ইবনে হিব্বান, সূত্র 'তারগীব-তারহীব', হাদীস নং-৫১৩
গ. হজরত উম্মে সালমা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, গৃহাভ্যন্তরই হলো মহিলাদের জন্য উত্তম মসজিদ। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস নং-২৬৫৯৮) উপর্যুক্ত সহিহ হাদিসসমূহ দ্বারা স্পষ্ট প্রমাণিত হয় :
ক. মহিলাদের নামাজের জন্য তাদের নিজ গৃহকোণ মসজিদ অপেক্ষা উত্তম।
খ. রাসুল (সা.) নিজেই মহিলাদেরকে মসজিদে গমন থেকে নিরুৎসাহিত করেছেন।
গ. রাসুল (সা.) যে পন্থাকে উত্তম বলেছেন তার বিপরীতটা উত্তম ও সওয়াবের কাজ হতেই পারে না। কেউ এ ধরনের মনোভাব পোষণ করলে তা হবে চরম বেয়াদবি।
বি.দ্র. হাদিসের কয়েকটি বর্ণনা, যা মহিলাদের মসজিদে আসা প্রসঙ্গে পাওয়া যায়, তা প্রাথমিক যুগের কথা, তখন পুরুষরাও সব মাসআলা জানত না, তখন কয়েকটি কঠিন শর্তসহকারে রাতের আঁধারে নির্দিষ্ট দরজা দিয়ে একদম পেছনের কাতারে দাঁড়ানোর অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে নবী (সা.) উক্ত অনুমতি প্রত্যাহার করে তাদেরকে ঘরে নামাজ পড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যেমনটি ওপরে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং ওইসব হাদিস দ্বারা বর্তমানে মহিলাদের মসজিদে গমন জায়েজ বলা যাবে না।
মহিলাদের মসজিদে গমন প্রসঙ্গে বিশিষ্ট সাহাবীদের উক্তি :
ক. সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারিণী ও উম্মতের শ্রেষ্ঠ মহিলা আলেম আম্মাজান হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, যদি রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দেখতেন যে মহিলারা সাজসজ্জা গ্রহণে, সুগন্ধি ব্যবহারে ও সুন্দর পোশাক পরিধানে (মুসলিম শরীফের টীকা দ্রষ্টব্য) কী পন্থা উদ্ভাবন করেছে তাহলে অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে যেতে নিষেধ করে দিতেন, যেমন নিষেধ করা হয়েছিল বনি ইসরাঈলের মহিলাদেরকে। (সহিহ বুখারী, হাদীস নং-৮৬৯, সহিহ মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-৪৪৫)
খ. হজরত আমর শাইবানী (রহ.) বলেন, আমি (এ উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ফিকাহবিদ) সাহাবী হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-কে দেখেছি যে তিনি জুমু'আর দিনে মহিলাদেরকে মসজিদ হতে বের করে দিতেন এবং বলতেন, তোমরা নিজ ঘরে চলে যাও, তোমাদের জন্য ইহাই উত্তম। (হাদিসটি ইমাম তাবারানী নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণনা করেছেন। 'তারগীব-তারহীব', হাদিস নং-৫২৩)
উল্লেখ্য, এ হলো নবীযুগের পরপরই মসজিদে গমনকারিণী মহিলাদের অবস্থার পরিবর্তনে হজরত আয়েশা (রা.)-এর উক্তি ও হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.)-এর আমল। অথচ তখনকার মহিলারা ছিলেন সাহাবী অথবা তাবেঈ, অন্য কেউ নন। পক্ষান্তরে আজ চৌদ্দ শতাব্দী পরে যখন মহিলাদের তেল, সাবান, শ্যাম্পুসহ সকল প্রকার প্রসাধনীই সুগন্ধিযুক্ত। অধিকাংশ পর্দা করে না। যারা বোরকা পরে তাদের অধিকাংশই সৌন্দর্যের কেন্দ্রস্থল চেহারাকে উন্মুক্ত রাখে এবং তাদের বোরকা ও পোশাক হয় নজরকাড়া ফ্যাশনের। এ অবস্থা রাসুল (সা.) দেখলে মহিলাদেরকে মসজিদে গমনের অনুমতি দিতেন, এটা বিবেকবান কেউ কি কল্পনা করতে পারে?
মহিলাদের মসজিদে গমনের ব্যাপারে হানাফী, মালেকী ও শাফেয়ী মাজহাবের সিদ্ধান্ত :
ক. হানাফী মাযহাব : সকল মহিলার জন্য জামা'আত, জুমু'আ, ঈদ ও পুরুষদের মাহফিলে অংশগ্রহণ সর্বাবস্থায় মাকরুহে তাহরীমী। আল ফিকহুল ইসলামী ওয়া আদিল্লাতুহু : ১/১১৭২।
খ. মালেকী মাজহাব : অতি বৃদ্ধা মহিলা ছাড়া সকল মহিলার জন্য জুমু'আয় অংশগ্রহণ হারাম।
গ. শাফেঈ মাযহাব : অতি বৃদ্ধা মহিলা ছাড়া সকল মহিলার জন্য জুমু'আসহ যেকোনো জামা'আতে অংশগ্রহণ সর্বাবস্থায় মাকরুহে তাহরীমী। 'আল ফিকহু আলাল মাযাহিবিল আরবা'আ', ১/৩১১, ৩১২।
প্রিয় পাঠক! উপর্যুক্ত আলোচনায় আমরা যা পেলাম এর বিপরীতে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য হাদিস ও ফিকহী বর্ণনা নেই, যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, কোনো যুগে মহিলাদের মসজিদে গমন ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাত, মুস্তাহাব কিংবা অধিক সওয়াবের কাজ ছিল এবং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), সাহাবীগণ ও পরবর্তী ফিকাহবিদ ইমামগণ মহিলাদেরকে মসজিদে গমনে উৎসাহিত করেছেন। তাহলে বর্তমানে নৈতিক অবক্ষয়ের চরম মুহূর্তে কী করে তা সাওয়াব ও আগ্রহের কাজ হতে পারে? যে সকল আলেম বা স্কলার বর্তমানে মহিলাদেরকে মসজিদে গমনে উৎসাহিত করেন, তাঁরা কি রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), হজরত আয়েশা (রা.) ও ইবনে মাসউদ (রা.) এবং মুজতাহিদ ইমামগণের চেয়েও বেশি যোগ্য ও অনুসরণীয় হয়ে গেলন? যে সকল স্কলার অসংখ্য বেগানা মহিলাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ইসলামী লেকচার প্রদান করেন। কিংবা লক্ষ লক্ষ বেগানা মহিলাকে দেখার জন্য বিনা প্রয়োজনে নিজেকে উপস্থাপন করেন। অথচ সহিহ হাদিসের আলোকে এ সবই নিষিদ্ধ। (দেখুন : সুনানে তিরমিযী, হাদিস নং-২৭৮২, সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং-৪১১২)। বাস্তব দ্বীন ও ইসলামের ক্ষেত্রে এরাও কি গ্রহণযোগ্য হয়ে গেলেন?
মাসআলা ক. একই নামাজে জামা'আতে নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে যে সকল পুরুষের সম্মুখে কিংবা পাশে কোনো মহিলা থাকবে সে সকল পুরুষের নামাজ ফাসিদ হয়ে যাবে। ফাতাওয়ায়ে শামী : ১/৫৭৩, আলমগীরী : ১/৯৭)
এ কারণেই হারাম শরিফে পুরুষদের সম্মুখে ও পাশে দাঁড়ানো থেকে মহিলাদেরকে নিবৃত্ত করতে কর্তৃপক্ষ সর্বশক্তি নিয়োগ করে থাকে।
মাসআলা খ. মসজিদের যে তলায় মহিলারা জামা'আতে অংশগ্রহণ করে তার উপরতলায় বরাবর স্থানের পেছনে যে সকল পুরুষ দাঁড়াবে তাদের সকলের নামাজ ফাসিদ হয়ে যাবে। ফাতাওয়ায়ে শামীসহ দুররে মুখতার : ১/৫৮৪, ফাতাওযায়ে আলমগীরী : ১/৯৭)
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!