Thursday, March 23, 2017

এক মুষ্টি পরিমাণ দাড়ি রাখা ওয়াজিব

আরবি ভাষায় দাড়িকে বলা হয় লিহইয়া বা লাহয়া। এর আভিধানিক অর্থ হলো থুতনিসহ মুখের দুই পাশের ওই হাড়, যার ওপর দাঁতগুলো অবস্থিত। প্রাপ্ত বয়সে ওই হাড়ের ওপর যে লোম বা কেশ গজায়, ওই লোম বা কেশগুলোকেই হাড়ের নামকরণে লিহইয়া বলা হয়।

দাড়ির চৌহদ্দি হলো গালের শেষ ভাগে এবং গলার শুরু ভাগে বাম কান থেকে ডান কান পর্যন্ত বিস্তৃত লম্বা হাড্ডিতে গজানো চুল হলো দাড়ির সীমারেখা। আল্লামা ইবনে আবেদিন যেমন বলেছেন- দাড়ি সম্পর্কে মূল কথা হলো, দাড়ি রাখা ওয়াজিব। এর শরয়ি পরিমাপ হলো এক মুষ্টি পরিমাণ। দাড়ি রাখা ইসলামের শেআর এবং নিদর্শন। এটি সব নবীর সুন্নাত। এটি ভদ্রতা, মহত্ত্ব এবং ইজ্জত ও সম্মানের আলামত। এর মধ্যেই রয়েছে পৌরুষত্বের পরিপূর্ণতা। এভাবে দাড়ি রাখা নবী করিম (সা.)-এর সার্বক্ষণিক আমল ছিল। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন, তাবে-তাবেইন, ফুকাহা, মুহাদ্দেসিন, সলফে-সালেহিনেরও আমল ছিল এরূপ। নবী (সা.) এটিকে ফিতরাত তথা মানুষের প্রকৃতি বলেই আখ্যায়িত করেছেন। সুতরাং দাড়ি রাখা আবশ্যক। চেঁছে ফেলা বা এক মুষ্টির ভেতর কাটা হারাম ও কবিরা গুনাহ।

নবী (সা.) দাড়ির কতখানি গুরুত্ব দিতেন এবং ইসলামে দাড়ি রাখার আবশ্যকতা কোন পর্যায়ের, তা নিচের কয়েকটি হাদিস থেকে অনুমেয়-

১. হজরত ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসুলুল্লাহ (সা.) মোচ খাটো এবং দাড়ি লম্বা করার নির্দেশ দিতেন (সহিহ মুসলিম ১/১২৯, ২৫৯)।

২. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা মুশরিকদের বিরোধিতা করো, দাড়ি লম্বা করো, মোচ খাটো করো (সহিহ বুখারি ২/৮৭৫)।

৩. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা মোচ খাটো করো এবং দাড়ি নিচের দিকে ঝুলাও, অগ্নিপূজারীদের বিরোধিতা করো (সহিহ মুসলিম ১/২২২, ২৬০)।

৪. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা মোচ খাটো এবং দাড়ি লম্বা করো (সহিহ বুখারি ২/৮৭৫)।

৫. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- তোমরা দাড়ি লম্বা করো, মোচ খাটো করো এবং তোমাদের চুলের সাদা রং পরিবর্তন করো। ইহুদি ও নাসারাদের সাদৃশ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকো (কানজুল উম্মাল ৬/৬৫৩)।

৬. হজরত আয়েশা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ১০টি জিনিস ফিতরাত বা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ ছোট করা, দাড়ি বড় করা, মিছওয়াক করা, নাকে পানি দিয়ে তা ঝেড়ে ফেলা, নখ ছোট করা, আঙুলের গিরা ও জোড়া ধৌত করা, বগলের চুল উপড়ানো, নাভির নিচের চুল কামানো, পেশাব-পায়খানার পর পানি ব্যবহার করা। বর্ণনাকারী বলেন, আমি ১০ নম্বরটি ভুলে গেছি, তবে মনে হয় তা হবে কুলি করা (সহিহ মুসলিম ১/২২৩)।

৭. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- অগ্নিপূজকরা মোচ লম্বা করে, দাড়ি নিশ্চিহ্ন করে। তাই তোমরা তাদের বিরোধিতা করো, মোচ খাটো ও দাড়ি লম্বা করো (আত তারিখুল কাবির ১/১৪০)।

৮. হজরত হাসান (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- ১০টি স্বভাব এমন ছিল, যেগুলো অবলম্বন করে কওমে লুত ধ্বংস হয়ে গেছে। তার মধ্যে একটি দাড়ি কর্তন করা ও গোঁফ লম্বা করা (দুররে মনসুর ৫/৬৪৪)।

৯. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উৎবা (রা.) সূত্রে বর্ণিত- জনৈক অগ্নিপূজক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এ অবস্থায় এলো যে, তখন সে তার দাড়ি কামিয়ে ফেলেছে এবং মোচ লম্বা করে রেখেছে। এ অবস্থায় নবী (সা.) বললেন, তুমি এটা কী করেছ? সে উত্তর দিল, এটা আমাদের ধর্মে আছে। তখন নবী করিম (সা.) ইরশাদ করলেন, আমাদের ধর্মে আছে মোচ কর্তন করা এবং দাড়ি লম্বা করা (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ৮/৩৭৯)।

১০. আরেক হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন- আল্লাহ তায়ালার কিছু ফেরেশতা আছেন, যাঁদের তাসবিহ হলো এই পবিত্র ওই সত্তা, যিনি পুরুষদের দাড়ি দিয়ে সজ্জিত করেছেন আর নারীদের করেছেন সুন্দর চুলের বেণি ও খোঁপা দিয়ে (কাশফুল খিফা ১/৫৩৮, তাকমিলায়ে বাহরুর রায়েক ৮/৩৩১)। দাড়ি রাখার ব্যাপারে অসংখ্য হাদিস থেকে ১০টি হাদিস এখানে উল্লেখ করা হলো। প্রিয় নবীজি (সা.)-এর কাছে দাড়ির গুরুত্ব কতটুকু ছিল এবং ইসলামে এর আবশ্যকতা কোন পর্যায়ের, উল্লিখিত হাদিসগুলো থেকে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

দাড়ির পরিমাপ কী হবে?

এককথায় বলা যায়, নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের দাড়ি যেভাবে এবং যেটুকু ছিল, সেটুকু রাখাই মূল বিষয়। হাদিস শরিফে এসেছে- রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন চিন্তিত হতেন, তখন তিনি নিজ হাতে দাড়ি ধরে তা দেখতেন (কানজুল উম্মাল ১/৭০১)।

আরেক হাদিসে আছে- হজরত রুয়াইফ ইবনে সাবেত (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাকে লক্ষ করে বললেন, হে রুয়াইফ! আমার ওফাতের পর তুমি যদি বেঁচে থাকো, তাহলে মানুষদের বলে দেবে, যে ব্যক্তি দাড়ি বেঁধে রাখে অথবা গলায় রশি বাঁধে কিংবা কোনো জীবের গোবর বা হাড় দিয়ে ইসতিঞ্জা করে, রাসুলুল্লাহ (সা.) তার ব্যাপারে মুক্ত (মিশকাত ২/৪৩, আবু দাউদ)।

আরেক হাদিসে আছে- হজরত আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন অজু করতেন, তখন এক তালু পানি নিয়ে গলার নিচে রাখতেন এবং তা দিয়ে তাঁর দাড়ি মোবারক খিলাল করতেন। আর বলতেন এভাবে আমার রব আমাকে আদেশ করেছেন (আবু দাউদ, মেশকাত ১/৪৬)।

আরেকটি হাদিসে আছে- হজরত আবু মা'মার (রহ.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা হজরত খাব্বাব (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) কি জোহর এবং আসরের নামাজে কিরাত পাঠ করতেন? তিনি উত্তরে বললেন, হ্যাঁ। আমরা বললাম, আপনারা কিভাবে বুঝতেন? তিনি বলেন, তাঁর দাড়ি নড়াচড়া করার দ্বারা। (সহিহ বুখারি ১/৭৬০)। এ কয়টি হাদিসসহ আরো বহু হাদিস থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, নবী (সা.)-এর দাড়ি মোবারক লম্বা ছিল।

দাড়ির পরিমাণ কতটুকু হবে?

হাদিস শরিফে আছে- হজরত আমর ইবনে শুয়াইব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) স্বীয় দাড়ির নিচ ও আশপাশ থেকে মুষ্টি পরিমাণের বাইরের অংশ কাটছাঁট করতেন। (শরহু শিরআতিল ইসলাম-২৯৮)।

এ হাদিস থেকে স্পষ্ট হয়, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর দাড়ি মোবারক এক মুষ্টির বেশি ছিল এবং এক মুষ্টি পরিমাণ রেখে বাকিটা কর্তন করা যাবে।

সাহাবায়ে কেরাম দাড়ি লম্বা রেখেছেন। তবে এক মুষ্টির পর কাটার স্বীকৃতি সাহাবায়ে কেরামের আমলে পাওয়া যায়।

হজরত মারওয়ান ইবনে সালেমে মুকাফা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ইবনে উমর (রা.)-কে দেখেছি, তিনি নিজের দাড়ি মুঠ করে ধরে বাকিটুকু কেটে ফেলতেন (আবু দাউদ ২/৭৬৫)।

হজরত ইবনে উমর (রা.) হজ ও উমরার সময় নিজ দাড়ি মুঠ করে ধরে বাইরের অংশটুকু কেটে ফেলতেন (সহিহ বুখারি ৭/৮৩ হা. ৫৮৯২)।

৩. আবু জুব'আ (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) স্বীয় দাড়ি মুঠ করে ধরে বাইরের অংশটুকু কেটে ফেলতেন (ফতহুল বারি ১০/৬৩২)

৪. হজরত হাসান (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, তাঁরা (সাহাবিগণ) মুঠের বাইরের অংশটুকু কেটে ছোট করাকে অনুমোদন করতেন (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা ৫/২২৬ হা. ২৫৪৭০)।

হাদিসের অসংখ্য বাণী থেকে প্রাপ্ত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ, আমল ও সাহাবায়ে কেরাম, তাবেইন তাবে-তাবেইনের আমল, ইমাম ফুকাহা ও মুহাদ্দিসিনের আমল ও দিকনির্দেশনার আলোকে আকাবের উলামায়ে কেরাম দাড়ির ব্যাপারে যে বিধান ঠিক করেছেন তা নিম্নরূপ :

দীর্ঘ আলোচনার পর হজরত খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) লেখেন- দাড়ি কর্তন করা বর্তমান যুগে ইহুদি নাসরাদের শে'আর বা নিদর্শনে রূপান্তরিত হয়েছে। মুসলমানদের মধ্যে এমন লোকও তা গ্রহণ করছে, যাদের সঙ্গে দ্বীনের সম্পর্ক নেই। বরং ইংরেজদের রীতিনীতি অনুযায়ী চলাকে তারা পছন্দ করে।

এরপর ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এর উক্তি উল্লেখ করেন- দাড়ি মুণ্ডানোর মতো দাড়ি কাটাও হারাম (বজলুল মজহুদ ১/৩৩)।

শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) লেখেন- দাড়ি মুণ্ডানো হারাম। এটি পশ্চিমা ও অমুসলিম মুশরিকদের রীতি। এক মুষ্টি পর্যন্ত দাড়ি রাখা ওয়াজিব। (আশইয়াতুল লুম'আত ১/২১২)।

হজরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) বাওয়াদেরুন নাওয়াদেরে লেখেন- 'দাড়ি মুণ্ডানো ও কাটা হারাম। এর ওপরে উম্মতের ঐকমত্য রয়েছে (২/৪৪৩)।

এক মুষ্টির আগে দাড়ি কাটা উম্মতের কেউ অনুমতি দেননি (তানকিহুল ফাতাওয়া আল হামেদিয়া ১/৩৫১)।

বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফয়জুল বারিতে উল্লেখ আছে- এক মুষ্টির কমে দাড়ি কাটা সব ইমামের ঐকমত্যের ভিত্তিতে হারাম (৪/৩৮০)।

দাড়ির ব্যাপারে দীর্ঘ আলোচনা করা যায়। কারণ কিতাবাদিতে দাড়ির এত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যে এ বিষয়ে বড় বড় গ্রন্থও রচিত হয়েছে। সামান্য পরিসরে এ আলোচনায় এ কথাই প্রমাণিত হলো, দাড়ি রাখা ওয়াজিব। এর সর্বনিম্ন পরিমাপ এক মুষ্টি। এক মুষ্টির পর দাড়ি কাটার অনুমতি আছে। কিন্তু এক মুষ্টির কমে দাড়ি কাটা অথবা মুণ্ডানো সম্পূর্ণ হারাম। যারা সর্বক্ষণ হারাম কাজে লিপ্ত, তারা শরয়ি ভাষায় ফাসিক।

থুতনির উপর এবং ঠোটের নিচের চুল যাকে আমরা নিম দাড়ি বা বাচ্চা দাড়ি বলি তা বেশী বড় হলে পানি পান করতে বা খাবার খাওয়ায় সমস্যাককর হলে কিংবা অন্য কোন অসুবিধা হলে তা কাটার অবকাশ আছে। তবে একেবারে কামানো ও উপড়ানো বেদআত ও নিষিদ্ধ।

সুতরাং মুসলমানদের এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা উচিত। কারণ দাড়ি কাটা, ছাঁটা বা মুণ্ডানোর গুনাহ সর্বক্ষণ নিজের সঙ্গে লেগে থাকে। যতক্ষণ মুসলমানের জীবনে এ অবস্থা পরিগ্রহ, ততক্ষণ তিনি গুনাহে কবিরার সঙ্গে জড়িত বলে বিবেচিত। এ কারণে বিষয়টি বড়ই জটিল ও পাপ। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হেফাজত করুন।


শেয়ার করুন

0 Comments:

একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!