হযরত মাওলানা মুহাম্মদ ইলিয়াছ (র.) এর শৈশবকালঃ কেটেছে এক ভিন্ন পরিবেশে। আরো দশজনের চেয়ে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। একটি স্বতন্ত্র ঈমানী আবহে। এক নূরানী ষ্পর্শ ছিল তার জন্মের পর থেকেই। কিছু পুত-পবিত্র রাবেয়া চরিত্রের মা, মামী, নানীদের পরশে তাঁর বেড়ে ওঠা। দূরন্তপনা কিংবা ময়না-তোতা পাখির গল্প শুনে তিনি বেড়ে ওঠেননি। তিনি যাদের কোলে বড় হয়েছেন তাদের মুখে ছিল লা-ইলাহার শব্দমালা, হাতে থাকতো প্রগাঢ় ভালবাসার এক তাছবিহ দানা।
.
মায়ের পেটে যখন, তখনই তিনি পেয়েছিলেন প্রশিক্ষণ। তার হাফেজা আম্মা মুহতারামা ছাফিয়া ছিলেন এক উঁচু মাপের হাফেজা এবং আল্লাহর ওলী। এত বেশি কোরআন তেলাওয়াত করতেন যে কখনো কখনো প্রতিদিন এক খতমের বেশি হয়ে যেত। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় ইলিয়াছ আখতার।
.
মা-নানী আদর করে ডাকতেন আখতার। শৈশবে তার বেড়ে ওঠা-ই ছিল এক দ্বীনি মিযাযে, ঈমানী তপ্ত পরিবেশে, আ’মালী এক দীপ্তিময় রোশনীতে। যে আলোয় আলোকিত হয়ে উঠেছিল তার অবুঝ মন। সে আলোর ঝলকানীতে তিনি সত্যই আখতার (নির্বাচিত) হয়ে উঠে ছিলেন এক অন্যরকম বালক হিসেবে।
নানীর বাড়িতে তার শৈশবের দিনগুলো কেটেছে। ভারতের কান্ধালার এই ঐতিহ্যবাহী পরিবার ছিল ইলম ও আমলের এক আলোকবর্তিকা। এই পরিবারের মহিলাদের আমলের জজবা আর জ্ঞানের পরিধি মশহুর ছিল দূর বহু দূর পর্যন্ত। তাদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আখেরাত। জান্নাতের মোহে আচ্ছন্ন ছিল তাদের পবিত্র সংসার।
.
যাদের ষ্পর্শে তার শিশুকাল:
.
একজন দ্বীনদার মায়ের দ্বারা দ্বীনি পৃথিবী তৈরি হতে পারে। মুহাম্মদ ইলিয়াছ (র.) এর মা, নানী ছিলেন এর উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তিনি ছিলেন তার মায়ের আদর্শের এক প্রতিকৃত। তার নানীজী আমাতুর রহমান ছিলেন এক তাপসী নারী। তার এবাদত বন্দেগী ও নামাজের খুশু খুজু ছিল খুব-ই উঁচু স্তরের। ইলিয়াছ (র.) এর নানী এই মহীয়সীর শেষ জীবনে তাঁর অবস্থা ছিল এই যে, নিজে কখনো খাবার চেয়ে খেতেন না। কেউ সামনে রেখে দিলে মুখে দিতেন। বড় পরিবার ছিল তার। কখনো কাজের চাপে কেউ তার খাবার দিতে ভুলে গেলে তিনি কোন অনুযোগ করতেন না।
.
একবার কেউ তাকে জিজ্ঞাসা করলো এমন দুর্বল অবস্থায় না খেয়ে থাকেন কিভাবে ? তিনি বললেন, ‘আল-হামদুলিল্লাহ, তাসবীহ থেকেই আমি রূহানী খাদ্য লাভ করি।’
তিনি উম্মে জি নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন। তার মুখে মুখে থাকতো আল্লাহর জিকির আর ঈমানদীপ্ত ঘটনাবলী। তিনি আদরের নাতী ইলিয়াছ আখতারকে স্নেহ করতেন সবচেয়ে বেশি। তার কোলে পিঠেই বেড়ে উঠেছেন জগৎখ্যাত এই আল্লাহর ওলী।
তিনি ঘুমপাড়ানি মাসি-ফিসি আর রাজা-বাদশাহ, ভূত-প্রেত ও শিয়াল-শকুনের গল্পের বদলে প্রিয় নাতীদের ঘুম পাড়াতেন নবীদের ঈমান জাগানীয়া কাহিনী, সাহাবাদের ঈমানদ্বীপ্ত ঘটনাবলী, আউলিয়াদের জীবন-চরিত্র বলে। একদিন হযরতজী ইলিয়াছ (র.) আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী মিয়া নদভীকে মা-নানীদের ঈমানদ্বীপ্ত এসব ঘটনাবলীর কথা বলতে বলতে আবেগী হয়ে বললেন, মাওলানা এমন মায়েদের কোলেই আমরা প্রতি পালিত হয়েছি। পৃথিবীতে এ ধরণের কোল এখন কোথায় আর পাওয়া যাবে।
ইলিয়াছ (র.) অন্য একদিন তার শিশুকালের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, আমি মা, খালা, নানীদের মুখে আউলিয়াদের ঘটনা এত শুনেছি, তবুও বার বার শুনার পরও মনে হতো যেন এসব গতকালের ঘটনাবলী। আলী মিয়া নদভীকে তিনি বলেন, ‘আপনার রচিত সীরাতে সৈয়দ আহমদ শহীদ আমার সেই জানা শোনায় নতুন কিছু সংযোজন করতে পারেনি।’
.
যে মহীয়সীর কোলে তার প্রতিপালন :
.
তার মহীয়সী আম্মা মুহতারামা সাফিয়্যা প্রথম জীবনে হাফেজ ছিলেন না। কিন্তু তিনি ছিলেন খান্দানের এক আলোচিত দ্বীনি রমনী। কোরআন তরজমা, উর্দু তাফসির, মাযাহিরে হক, মাশারিফুল আনওয়ার হিছনে হাছিনের মতো গ্রন্থ সমূহ ঘরে বসেই তিনি রপ্ত করেছিলেন। এছাড়া বহু উচ্চ পর্যায়ের কোরআন-হাদীস বিষয়ক তাফছির ও হাদীসের গ্রন্থ কিতাবাদি ছিল এ পরিবারের মেয়েদের সাধারণ দৈনন্দিন নেছাব ও পাঠ্যসূচি। তাদের মুখে মুখে আলোচিত হতো বুযুর্গদের কাহিনী। হযরত সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভী, হযরত শাহ আব্দুল আজিজ (র.)-এর ঘটনাবলীর চর্চা হতো সরগরম নিত্যদিন। এর ফলে ছাফিয়া (র.) ও বেড়ে উঠেছিলেন ঈমান দীপ্ত এক আলোকিত নারী হিসাবে। ছাহাবা চরিত্রের অনুপম এক দৃষ্টান্ত ছিল তার জীবনে। সুন্নত আর আমলের আবহে ভরপুর ছিল তার কৈশোর ও তারুন্যের দিনগুলো।
.
তিনি সেই ফিকিরের ফসল :
.
উম্মে জী খুব পেরেশান ছিলেন ইংরেজদের নির্যাতনের ফলে ভারতবর্ষ হতে আলেম-উলামা খতম হয়ে যাচ্ছেন দেখে। বৃটিশদের শাসনের আধিপত্যের ফলে দিন দিন মানুষ দ্বীন ছেড়ে দূরে চলে যাচ্ছে। তিনি চাইতেন তার গুণবতী মেয়ের বিয়ে হোক একজন বুযুর্গ আলেমের সাথে। যাদের গর্ভে আলোকিত হয়ে জন্ম নিবে চেরাগে মুহাম্মদ। আলেম-উলামায় ভরে উঠবে সে খান্দান এবং সারা দুনিয়া।
.
এক বিবাহ অনুষ্ঠানে তার দাওয়াত আসলে তিনি সেখানে উপস্থিত হন। ঐ বিবাহের নানা বিষয়াদি দেখে তার মন বিরহে ভরে উঠেছিল। তিনি এক কোণে আরো কজন দ্বীনদ্বার মহিলাদের সাথে এসব বিষয়ে আলাপ করছিলেন এবং দুঃখ করছিলেন চলমান অবস্থা নিয়ে আফসোস করছিলেন উলামায়ে কেরামের মূল্য অনুভবে।
সেই মজলিসে উপস্থিত দ্বীনদ্বার নারীদের তিনি নিজের মেয়ের কথা বললেন এবং জানালেন আলেম পাত্রের হাতে এই দ্বীনি মেয়েটিকে তুলে দিতে চান, যেন ঐ খান্দানে আলেম তৈরি হয়। মজলিসে উপস্থিত একজন জানালেন তার এক ছেলে রয়েছে নাম মাওলানা মুহাম্মদ ঈসমাইল। এই সূত্র, এই আবেগ আর দরদ মাখা আগ্রহ মুহতারামা বিবি ছাফিয়া ও মাওলানা মুহাম্মদ ঈসমাইলকে পরিচয় সূত্রে এক সংসারে আবদ্ধ করেন। ৩১ শে অক্টোবর ১৯৬৮ সালে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
.
এই সেই আমলের বরকত :
.
বিবাহের পর প্রথম পুত্র মাওলানা হাফেজ ইয়াহইয়া (র.) ছাহেব দুধ পান করার সময় তিনি হেফজ শুরু করেছিলেন। তখন তিনি এত বেশি কোরআন পড়েছেন মাত্র দু’এক বছরের মধ্যে পূর্ণ হাফেজা হয়ে গেছেন। তার স্মরণ এত পুক্তা ছিল যে সাধারণ হাফেজগণ তার আশপাশে তেলাওয়াতের সাহস পেতেন না।
.
রমযানে দৈনিক এক খতম ও অতিরিক্ত দশপারা কোরআন তেলাওয়াত তাঁর নিয়ম ছিল। অর্থাৎ দৈনিক চল্লিশ পাড়া তেলাওয়াত করতেন। এভাবে তিনি প্রতি রমযানে চল্লিশ খতম কোরআন পড়তেন। তার হৃদয়গ্রাহী তেলাওয়াতে কালাম এত সাবলীল স্বতঃস্ফূর্ত ও শ্র“তিমধুর ছিল যে তিনি ঘরের কাজকর্মের ভিতর দিয়েও সর্বদা তার ঠোটে লেগে থাকতো মাহবুবে এলাহীর পবিত্র কালাম। তেলাওয়াতের সময় তার হাতে কোন না কোন কাজ চলতো। অনর্থক কথাবার্তা, গীবত শেকায়ত, গল্প গুজবে তিনি কখনো মশগুল হতেন না। সুন্নতে নববীর অনুসরণ আর তেলাওয়াত তাছবিহাত বাচ্ছাদের সহী তরবিয়ত-ই ছিল তার জীবনের একমাত্র ব্রত।
.
রমযান ছাড়া অন্য সময় গার্হস্থের কাম-কাজের পাশাপাশি তার দৈনিক আমল অযিফা/তাছবিহাত পড়ার পরিমান ছিল অবাক হওয়ার মতো। যার সংখ্যা তের হাজারের অধিক ছিল। কোরআনের সেই পবিত্র বাণী, ‘মুমিন নারী হোক কিংবা পুরুষ হোক যদি নেক আমল করে তবে তাকে নেক হায়াত দান করা হবে।’ তিনি ছিলেন, এই আয়াতের বাস্তব নমুনা। এই বিশাল আমল হায়াতে তাইয়িবা বা নেক জীবন লাভের দ্বারাই সম্ভব হয়েছিল।
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!