Sunday, January 22, 2017

রোহিঙ্গা সঙ্কট অতীত ও বর্তমান

রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। বর্তমান মিয়ানমারের সাবেক নাম বার্মা। অনুরূপ বর্তমান রাখাইন প্রদেশের সাবেক নাম আরাকান। এক সময় আরাকান স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র ছিল। এখন এটি মিয়ানমারের একটি প্রদেশ। আরাকান নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশ থেকে এবং মূল ভূখণ্ড মিয়ানমার থেকে পাহাড় দিয়ে বিচ্ছিন্ন। অতীতে ২০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে আরাকান বিস্তৃত ছিল। পরে আরাকান পার্বত্য জেলা এবং দক্ষিণের বেশির ভাগ অঞ্চল আরাকান থেকে পৃথক করায় বর্তমানে আরাকানের আয়তন ১৪ হাজার ২০০ বর্গমাইল। বেসরকারি হিসাব মতে, আরাকানের লোকসংখ্যা ৫০ লাখেরও বেশি। মিয়ানমারের ১৪টি প্রদেশের মধ্যে একমাত্র আরাকানই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ ছিল। মিয়ানমারের ৭০ লাখ মুসলমানের অর্ধেকের বেশি আরাকানের অধিবাসী।
মিয়ানমারের বর্তমান সরকারের পূর্ববর্তী সেনাসমর্থিত থিন সেনের সরকারের সময় রোহিঙ্গা শব্দটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বী এ সম্প্রদায়টি বাঙালি নামে অভিহিত হবে মর্মে নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ধরনের নির্দেশনা একটি জাতি বা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলেও থিন সেনরা এগুলোর অল্পই তোয়াক্কা করেন। আজ এরা মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের শুধু ধর্মবিশ্বাসের জন্য যেভাবে নৃশংসভাবে হত্যাসহ নিগৃহীত ও উৎপীড়ন করছে, তা ইতিহাসে বিরল। বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গারাই হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে সংখ্যাগুরুদের হাতে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিগৃহীত। জাতিসঙ্ঘের তথ্য মতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।
অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এ জনগোষ্ঠী মায়ু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কাছে) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ ও কাইয়ুকতাও শহরতলিতেই বসবাস করতে পছন্দ করত। এ অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।
ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দু’টি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। একসময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে ছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।
রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবেÑ সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এ ‘রহম’ থেকেই নাকি এসেছে রোহিঙ্গা। ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ওই রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইতিহাস জানায়, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। একসময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের বহু ভুল করে গেছে ব্রিটিশ শাসকেরা।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের ‘বিদেশী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ। সম্প্রতি মিয়ানমারে বর্ডার এলাকায় সীমান্ত চৌকিতে ৯ সেনাসদস্যকে হত্যার (কে বা কারা হত্যা করেছে তা এখনো অস্পষ্ট) জের ধরে চলছে এ মুসলিম রোহিঙ্গাদের ওপর ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য নির্যাতন। কয়েক দিনে হাজার হাজার নারী, শিশু ও নিরীহ মানুষকে বাড়িঘরসহ পুড়িয়ে ও গুলি করে নির্মম এবং নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হচ্ছে। সেনা অভিযানের নামে এ হত্যাযজ্ঞে অর্ধলাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বাড়িঘর হারিয়ে অনাহারে ও গাছের লতাপাতা খেয়ে বন-জঙ্গল, সাগর-কূল ও সীমান্ত এলাকায় অবস্থান করছে। এমনকি জীবন বাঁচাতে অনিশ্চিত গন্তব্যে সাগরের মধ্যে পাড়ি দিচ্ছে। এ অবস্থায় কোনো মানুষ নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। সম্ভাব্য সব ধরনের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া সময়ের দাবি।
[হাশিম বিন আবদুল হাকিম - নয়া দিগন্ত]

শেয়ার করুন

0 Comments:

একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!