‘ইসলামে শবে বরাত বলতে কিছু নেই’ এই দাবীর উত্তাপন বেশি দিন আগের নয়। গত কয়েক বছর ধরে শোনা যাচ্ছে যে, শবে বরাত (লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান) বিদআত, তা কেবল উপমহাদেশেই পালিত হয় এবং এর কোনো ফযীলত হাদীস শরীফে প্রমাণিত নেই। আবার এ রাতের ফযীলত সম্পর্কে যত রেওয়ায়েত (বর্ণনা) আছে সবই মাওযূ (বানোয়াট ও গুজব) অথবা যয়ীফ (দুর্বল)। কাজেই শবে বরাতকে ফযীলতপূর্ণ রাত মনে করে এ রাতে জাগ্রত থেকে নামায-দুআ ও যিকির-তেলাওয়াতসহ যে কোন নফল ইবাদত করা বিদআত ও নাজায়েয।
অথচ মুসলিম উম্মাহর মাঝে এ রাতটির গুরুত ও মহত্ত না আজকের, না বছর কয়েক পূর্বের বরং ইসলামের সূচনালগ্ন থেকে যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরেই এর ধারা চলে আসছে। আবার এমনও নয় যে, কারও ভিন্ন প্রক্রিয়ার স্পন্দনে রাতটির গুরুত্ব মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে, বরং এ রাতের ফযীলত ও গুরুত্ব সম্পর্কে দশজন সাহাবী থেকে মারফূ’ হাদীস (সরাসরি রাসূল থেকে) বর্ণিত, যা সমষ্টিগত দিক থেকে সন্দেহাতীতভাবে সহীহ এর মানে উন্নীত। মুহাদ্দিসীনে কেরাম স্বীয় হাদীসগ্রন্থসমূহে বিভিন্ন শিরোনামে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাদের কেউ কেউ এগুলো থেকে প্রমাণও গ্রহণ করেছেন। ফুকাহা ও মুফতীগণ হাদীসগুলোর আলোকে ফিকাহর কিতাবসমূহে মুবাহ-মুস্তাহাবের বর্ণনা দিয়েছেন।
এছাড়া অনেকে বিক্ষিপ্ত লিখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে এ রাতের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়সমূহ তুলে ধরেছেন। আর এ রাতকে কেন্দ্র করে প্রস্তুত করা হয়েছে গবেষণালদ্ধ অনেক প্রবন্ধ-নিবন্ধ ও ছোট-বড় অসংখ্য গ্রন্থ। সুতরাং শবে বরাতের ফযীলত ভিত্তিহীন বলা অজ্ঞতা বা ভ্রষ্টতা ছাড়া কিছুই নয়। নিম্নে এ সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা হল।
হাদীসের আলোকে শবে বরাত
প্রথম হাদীস :
عَنْ مَكْحُولٍ، عَنْ مَالِكِ بْنِ يُخَامِرَ، عَنْ مُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ ، عَنِ النَّبِيّ قَالَ يَطْلُعُ اللَّهُ إِلَى خَلْقِهِ فِي لَيْلَةِ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ فَيَغْفِرُ لِجَمِيعِ خَلْقِهِ إِلَّا لِمُشْرِكٍ أَوْ مُشَاحِنٍ
হযরত মুআয ইবনে জাবাল রা. বলেন, নবী কারীম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের চৌদ্দ তারিখ দিবাগত রাতে তথা শবে বরাতে) সৃষ্টিকুলের প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত আর সবাইকে মাফ করে দেন। সহীহ ইবনে হিব্বান, হা. ৫৬৬৫
দ্বিতীয় হাদীস :
عَنْ يَحْيَى، عَنْ عُرْوَةَ، عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهَا قَالَتْ: فَقَدْتُ رَسُولَ اللهِ لَيْلَةً فَخَرَجْتُ، فَإِذَا هُوَ بِالبَقِيعِ، فَقَالَ: أَكُنْتِ تَخَافِينَ أَنْ يَحِيفَ اللَّهُ عَلَيْكِ وَرَسُولُهُ؟ قُلْتُ: يَا رَسُولَ اللهِ! إِنِّي ظَنَنْتُ أَنَّكَ أَتَيْتَ بَعْضَ نِسَائِكَ، فَقَالَ: إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا، فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعْرِ غَنَمِ كَلْبٍ
আয়েশা রা. বলেন, এক রাতে আমি রাসূলুল্লাহকে বিছানায় না পেয়ে খুঁজতে বের হলাম, ‘বাকী’ নামক (জান্নাতুল বাকী) কবরস্থানে তাঁকে পেলাম। তখন (আমার অবস্থাদৃষ্টে) রাসূল বললেন, তুমি কি মনে কর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ধারণা করেছিলাম, আপনি অন্য কোন স্ত্রীর ঘরে (কারণবশত) তাশরীফ নিয়েছেন। তখন রাসূল ইরশাদ করলেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে দুনিয়ার আসমানে অবতরণ করেন এবং “কাল্ব” গোত্রের ছাগলসমূহের পশমের চেয়েও অধিক সংখ্যক গুনাহগারকে ক্ষমা করে দেন। (মুসনাদে আহমদ হা. ২৬০১৮; সুনানে তিরমিযী হা. ৭৩৯; ইবনে মাজা হা. ১৩৮৯)
সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা :
‘কালব’ গোত্রের কথা এই জন্য বলা হয়েছে যে, তখনকার সময় আরব দেশে তাদের চেয়ে বেশি ছাগল আর কারো ছিল না। উদ্দেশ্য হচ্ছে, উক্ত রাতে আল্লাহ পাকের ব্যাপক ও অধিকহারে মাগফিরাত ও ক্ষমার প্রতি উম্মতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। (শরহুয যুরকানী আলাল মাওয়াহিবিল লাদুন্নিয়্যা, যুরকানী ১০/৫৬০ )
শবে বরাত সম্পর্কে আরো নয়টি হাদীসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ
এ রাত সম্পর্কে উলিখিত প্রথম ও দ্বিতীয় হাদীসের মূল বক্তব্য সম্বলিত আরো নয়জন সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণনা পাওয়া যায়। লেখার কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় পৃথক পৃথকভাবে না বলে মূলকথা তুলে ধরা হলো।
উল্লিখিত সাহাবীদ্বয় ব্যতীত আরো যে সমস্ত সাহাবী রাসূল থেকে এ রাত সম্পর্কে হাদীস বর্ণনা করেছেন (সাহাবা এজন্য বলেছি যে, তাবিয়ী থেকেও এ রাত সম্পর্কে সহীহ ও দুর্বল সনদে বর্ণনা রয়েছে) তারা হলেন- পূর্বের সাহাবীদ্বয়সহ (৩) প্রথম খলীফা হযরত আবু বকর রা. (৪) আবু সা’লাবা আল-খুশানী (৫) আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (৬) আবু মুসা আল-আশআরী (৭) আবু হুরায়রা (৮) আউফ ইবনে মালিক (৯) উসমান ইবনে আবীল আস (১০) আবু দারদা (১১) ও আবু উমামা রাযিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ।
(প্রথম থেকে অষ্টম সাহাবী পর্যন্ত হাদীসসমূহ সবিস্তারে জানার জন্য দেখুন শায়খ আলবানীর “সিলসিলায়ে সহীহা” ৩/১৩৫-১৩৮ হা. ১১৪৪। নবম হাদীস দেখুন বায়হাকীর “শুয়াবুল ঈমান” হা. ৩৫৫৫। দশম হাদীস রয়েছে হাফেজ আব্দুল গণী মুকাদ্দিসী (মৃ. ৬০০ হি.) এর “আহাদীসুল জামায়ীলী” নামক গ্রন্থে হা. ৩৭। আর একাদশ হাদীস পাবেন হাসান খল্লাল (মৃ. ৪৩১ হি.) এর “আল-মাজালিসুল আশারা আল-আমালী” কিতাবে হা. ৩।)
চলবে...
লিখেছেন
মাওলানা সাঈদ অাহমদ (দা.বা.)
উস্তাদ, দারুল উলূম হাটহাজারী।
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!