আল্লাহ তাআলা তাঁর চিরন্তন ধারা অনুযায়ী কোন স্থানকে অন্য স্থানের উপর, কোন সময়কে অন্য সময়ের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্য দান করেছেন। মাহে রমজান সকল মাসের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও সুমহান। জুমার দিন অন্য দিনের তুলনায় মর্যাদাবান। অন্যান্য স্থানের উপর মক্কা-মদীনার অধিক সম্মান। অনুরূপ শবে কদরের পরে অন্যান্য রজনীর চেয়ে শবে বরাতের স্থান।
মুসলমানদের এই করুণ অবস্থায় যেখানে আমাদের এক হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া দরকার, সেখানে সাধারণ ও মুস্তাহাব বিষয়ে কলহ সৃষ্টি করা এবং এ নিয়ে মাতামাতি করা উম্মতের ঐক্যের জন্য অনেক ক্ষতিকর। তবে উম্মতের ঐক্যের পাশাপাশি, কুরআন-সুন্নাহর সঠিক বুঝের অভাবে কেউ যেন কোন আমল ছেড়ে না দেন কিংবা আমলের নামে বিদআত বা শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত না হয়ে পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখাও জরুরী। কারণ আমরা সবাই জানি আল্লাহ পাক মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। তাই ইবাদতে যাতে কম না হয় কিংবা ইবাদতে যাতে শরীয়তবিরোধী কিছু না হয় এজন্য আমাদেরকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
আজকাল শবে বরাত নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। শবে বরাতকে কেন্দ্র করে লোকজন কলহ-বিবাদে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কেউ এর ফাযায়েল ও গুরুত্ব বর্ণনা করছেন। আবার কেউ কেউ এর অস্তিত্বকেই পুরোদমে অস্বীকার করে বসছেন। এমন কি এটা হিন্দুদের লক্ষ্মীপূজা সাদৃশ্যও বলছেন নাউযুবিল্লাহ। আবার কেউ আমলের নামে এমন সব কাজও করছেন, যা কুরআন-হাদীসের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে অনেকে বিধর্মীদের রেওয়াজও অনুসরণ করেছেন।
এতদিন পর্যন্ত শবে বরাতকে কেন্দ্র করে একশ্রেণীর মানুষ বাড়াবাড়িতে লিপ্ত ছিল। তারা এ রাতটি উপলক্ষে নানা অনুচিত কাজকর্ম এবং রসম-রেওয়াজের অনুগামী হচ্ছিল। উলামায়ে কেরাম সবসময়ই এসবের প্রতিবাদ করেছেন এবং এখনো করছেন। ইদানিং আবার এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছাড়াছাড়ির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। তাদের দাবি হল, ‘ইসলামে শবে বরাতের কোন ধারণা নেই। এ ব্যাপারে যত রেওয়ায়েত আছে সব মাওযূ বা যয়ীফ। এসব অনুযায়ী আমল করা এবং শবে বরাতকে বিশেষ কোন ফযীলতপূর্ণ মনে করা শরীয়তের দৃষ্টিতে জায়েয নয়।’ তারা এসব বক্তব্যসম্বলিত ছোট ছোট পুস্তিকা ও লিফলেট তৈরি করে মানুষের মধ্যে বিলি করছে।
বাস্তবকথা হল, আগেকার সেই বাড়াবাড়ির পথটিও যেমন সঠিক ছিল না, এখনকার এই ছাড়াছাড়ি মতটিও শুদ্ধ নয়। কেননা শরীয়তে ছাড়াছাড়ির যেমন অবকাশ নেই, তেমনি বাড়াবাড়িরও কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। ইসলাম ভারসাম্যতার দ্বীন এবং এর সকল শিক্ষাই প্রান্তিকতামুক্ত সরল পথের নির্দেশনা দেয়।
শবে বরাতের ব্যাপারে সঠিক ও ভারসাম্যতাপূর্ণ অবস্থান হল, এ রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সম্মিলিতভাবে কোন রূপ না দিয়ে এবং এই রাত উদযাপনের বিশেষ কোন পন্থা উদ্ভাবন না করে বেশি ইবাদত করাও নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই রাতকে অন্য সব সাধারণ রাতের মত মনে করা এবং এ রাতের ফযীলতের ব্যাপারে যত হাদীস এসেছে তার সবগুলো ‘মাওযূ বা যয়ীফ’ মনে করা যেমন ভুল, তেমনি এ রাতকে শবে কদরের মত বা তার চেয়েও বেশি ফযীলতপূর্ণ মনে করাও একটি ভিত্তিহীন ধারণা।
আমাদের ধারাবাহিক আলোচনাতে শবে বরাতের সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে এবং বাড়াবাড়ি ছাড়াছাড়ির বিরুদ্ধে দলীল-প্রমাণ পেশ করা হয়েছে।
>> শবে বরাত পরিচিতি <<
আরবী বছর বা হিজরী সনের ৮ম ও রমযানের পূর্ব মাস হচ্ছে, শাবান। এ শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বলা হয় ‘শবে বরাত’।
শবে বরাতের আভিধানিক অর্থ
শবে বরাত দু’টি শব্দের সমষ্টি। ‘শব’ শব্দটি মূলত ফার্সী, যার অর্থ রাত, রজনী। ‘বরাত’ শব্দকে যদি ফার্সী ধরা হয় অর্থ হবে, সৌভাগ্য। আর শব্দদ্বয়ের একত্র অর্থ হবে, ভাগ্য রজনী বা সৌভাগ্যের রাত।
আর যদি ‘বরাত’ শব্দটি আরবী ‘বারাআত’ ((براءة শব্দের অপভ্রংশ ধরা হয়, তাহলে অর্থ হবে, পরিত্রাণ বা মুক্তি। যেমন, এ অর্থে কুরআনে কারীমে এসেছে। (সূরা কামার : ৪৩)
অতএব শব্দদ্বয়কে আরবীতে অনুবাদ করা হলে বলতে হবে, “লাইলাতুল “বারাআহ” ((ليلة البراءة। যেমন ইমাম বায়হাকী রাহ. (মৃ. ৪৫৮ হি.) “আদ-দা’ওয়াতুল কাবীর” গ্রন্থে একটি শিরোনাম দিয়েছেন এভাবে, “বাবুল কাওলী ওয়াদ-দুআ লাইলাতাল বারাআহ” (باب القول والدعاء ليلة البراءة)। তবে হাদীসের ভাষায় বলা হয়েছে, (ليلة النصف من شعبان) অর্থাৎ অর্ধ শাবানের রাত।
উল্লেখ্য, যারা বলেন, ‘শবে বরাত’ বলতে কোন শব্দ কুরআন-হাদীসে নেই, এর কোন ভিত্তি নেই বা পালন করা বিদআত ইত্যাদি। তাদের প্রতি সবিনয়ে প্রশ্ন থাকবে, নামায-রোযা বলতে কোন শব্দও কুরআন-হাদীসে নেই, বরং সালাত ও সওম রয়েছে। এ ক্ষেত্রে কী বলবেন?
চলবে...
লিখেছেন
মাওলানা সাঈদ অাহমদ (দা.বা.)
উস্তাদ, দারুল উলূম হাটহাজারী।
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!