যারা “প্রাণীর দেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী শরীরের অংশবিশেষ”কে ‘মাংস’ না বলে ‘গোশত’ বলতে চান তাদের উদ্দেশ্য ভালো বলেই মনে হয়। তারা ইসলামী স্বাতন্ত্রিকতাকে বজায় রাখতে ও সম্ভব্য শাব্দিক অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে বাঁচতে চাচ্ছেন। তাদের উদ্দেশ্য যেহেতু সৎ (ইতিবাচক ধারণা থেকে ধরে নিচ্ছি) সেহেতু তাদের সমালোচনা করা বা তাদেরকে কটাক্ষ করা আমার উদ্দেশ্য নয়।
০২. যারা ‘মাংস’ শব্দ বলা উচিত-অনুচিতের প্রশ্নটিকে জায়েয-না জায়েযের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তারা কোন গ্রহণযোগ্য দলীল, সেটি কুর’আন, হাদীস, ইজমা, ইজতিহাদ থেকে হোক কিংবা আকল অর্থাৎ যুক্তি থেকে হোক, দেননি এবং দিতে আগ্রহ বোধ করছেন না। অথচ ইসলামে কোন কিছু জায়েয-না জায়েয হতে হলে তার পক্ষে-বিপক্ষে প্রমাণ-যুক্তি লাগবে। প্রমাণহীন কোন বক্তব্য গ্রহণ করতে কোন মুসলিম বাধ্য নয়।
০৩. বাংলা ভাষায় ব্যবহারিত শব্দগুলো উৎপত্তিগতভাবে ৫ প্রকার। ১. তদ্ভব, ২. তৎসম, ৩. অর্ধ তৎসম, ৪. দেশি এবং ৫. বিদেশী। ‘মাংস’ শব্দটি উপরোল্লিখিত কোন প্রকার থেকে এসেছে তা জানা এক্ষেত্রে জরুরি। বাংলা অভিধানগুলো ঘেঁটে আমি যতটুকু জেনেছি, তা হলো ‘মাংস’ শব্দটির উৎস হচ্ছে সংস্কৃত (মন + স) থেকে।
০৪. ‘মাংস’ শব্দটি সংস্কৃত থেকে আসলেও এটি কোন কালেই ‘মাংশ’ বানানে ছিলো না। আমার দেখা সকল বাংলা অভিধানেই শব্দটির বানান ‘মাংস’ লেখা হয়েছে। (দেখুনঃ ঢাকার বাংলা একাডেমী (জানুয়ারী, ২০১১) প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এর ৯৬৮ পৃ.; কলকাতার সাহিত্য সংসদ (অক্টোবর, ২০০৭) প্রকাশিত ‘সংসদ বাংলা অভিধান’-এর ৬৯৩ পৃ.; কলকাতার এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লি. (ত্রয়োদশ সংস্করণ, ১৩৮৯) প্রকাশিত আধুনিক বঙ্গভাষার অভিধান ‘চলন্তিকা’ -এর ৫৮২ পৃ.।) তাহলে আমরা ‘মাংস’ শব্দের বানান ‘মাংশ’ পেলাম কোথায়?
০৫. ড. মুহাম্মদ এনামুল হক, শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ও স্বরোচিষ সরকার সম্পাদিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’, কলকাতার সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত ও শৈলেন্দ্র বিশ্বাস সংকলিত ‘সংসদ বাংলা অভিধান’ ও কলকাতার এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লি. প্রকাশিত ও রাজশেখর বসু সংকলিত ‘চলন্তিকা’, কোথাও ‘মাংশ’ বানানে কোন শব্দ নেই।
০৬. বাংলা একাডেমি ‘মাংস’ শব্দের অর্থ লিখেছে, ‘প্রাণীর দেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী শরীরের অংশবিশেষ’। (৯৬৮ পৃ.) শৈলেন্দ্র বিশ্বাস ‘মাংস’ শব্দের অর্থ লিখেছেন, ১. ‘জীবদেহের হাড় ও চামড়ার মধ্যবর্তী কোমল অংশবিশেষ’; ২. ‘মানুষের ভোজ্য মনুষ্যেতর প্রাণীর আমিষ বা পলল’। (৬৯৩ পৃ.) রাজশেখর বসু ‘মাংস’ শব্দের অর্থ লিখেছেন, ‘পশু মনুষ্যইঃর দেহের চর্ম ও অস্থির মধ্যবর্তী কোমল অংশ পিশিত’। (৫৮২ পৃ.) উপরোল্লিখিত অর্থসমূহ ছাড়া অন্য কোন অর্থ এসব অভিধানে লেখা হয় নি।
০৭. ‘মাংস’ শব্দের বানান ‘মাংশ’ লিখে যারা ‘মায়ের (গরুর) অংশ’ ব্যাসবাক্যে সন্ধিবিচ্ছেদ (!) করেন তারা বাংলা ব্যকরণের কোন নিয়মে তা করেন তা আমার বুঝে আসে না। আমার জানা মতে বাংলা ব্যকরণের কোনো নিয়মেই এই সন্ধিবিচ্ছেদ ও ব্যাসবাক্য গ্রহণযোগ্য নয়।
০৮. বাংলা ভাষার কোনো বিশেষজ্ঞ (হিন্দু কিংবা মুসলিম) ‘মাংস’কে তথাকথিত ‘মাংশ’ শব্দের অপভ্রংশ বা পরিবর্তিত রূপ বলে আখ্যায়িত করে তাকে হিন্দুদের বিশ্বাসজাত কোন শব্দ বলে উল্লেখ করেন নি, যেমনটা করেছেন কীর্তন বেদী, স্নাতক, আচার্য, উপাচার্য, বিশ্বভ্রম্মাণ্ড ইত্যাদি শব্দের ক্ষেত্রে। তাহলে কেন মাংসকে মাংশ ভেবে ভুল ব্যাখ্যা দেয়া হচ্ছে? বিস্তারিত জানতে ও প্রমাণ পেতে বাংলাভাষার যে কোন অভিধানে এই শব্দগুলোর অর্থ ও সংশ্লিষ্ট আলোচনা দেখুন। সনাতন ধর্মের বিশ্বাসজাত কিন্তু বাংলা ভাষায় বহুল ব্যবহৃত কিছু শব্দের ‘পোস্টমর্টেম রিপোর্ট’ জানতে পড়তে পারেন সালেহুদ্দীন জহুরী’র লেখা ‘শব্দ সংস্কৃতির ছোবল’ বইটি।
০৯. অনেকেই ‘মাংস’কে ‘গোশত’ বলতে উৎসাহিত করেন। কিন্তু বাংলা ‘মাংস’ শব্দ বাদ দিয়ে ফার্সী শব্দ ‘গোশত’ (ফার্সী গাফ লিখতে পারছি না।) শব্দের প্রতি এতো আগ্রহের কারণ কী তা আমি জানি না। তবে কেউ যদি ফার্সীকে ইসলামী ভাষা আর বাংলাকে অনৈসলামিক ভাষা বলে ভাবেন এবং মনে করেন, এবং সেই ভেবে ‘গোশত’ বলতে উৎসাহিত করেন তাহলে ভুল করবেন। কারণ আল্লাহর নিকট কোন ভাষাই খারাপ বা পরিত্যাজ্য নয়। ফার্সীর প্রতি এতো আগ্রহ কেনো? বেশি আগ্রহ থাকা উচিত আরবীর প্রতি। এর অনেক কারণ আছে। সে হিসাবে মাংসকে “লাহম” বলা উচিত। আমরা কি সেটি বলবো?
১০. তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেই যে, ‘মাংস’ দ্বারা হিন্দুদের বিশ্বাস অনুযায়ী মা (গরু)-এর অংশ বুঝাচ্ছে, তাহলে শুধু গাভীর মাংসকে গোশত বলতে হবে। অন্যগুলোর যেমন ছাগল, খাসি, মুরগী ইত্যাদির ‘গোশত’কে কি মাংস বলতে দোষ হবে?
মোটকথা, আমার এখন পর্যন্ত স্টাডি অনুযায়ী ‘মাংস’কে ‘মাংশ’ কিংবা ‘গোশত’ কোনটা বলাই না জায়েয নয়। এক্ষেত্রে ইসলামের মূলনীতি হলো, “আল-আসলু আল-ইবাহা” অর্থাৎ মূল হলো বৈধতা। মুয়ামালাতের ক্ষেত্রে অর্থাৎ আকীদা বা ইবাদ
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!