Saturday, March 4, 2017

জামাআতের নামাযে মুকতাদী ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা বা অন্য কোন সূরা পড়বে না।

কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, জামাআতের নামাযে মুকতাদী ইমামের পিছনে সুরা ফাতিহা বা অন্য কোন সূরা পড়বে না।
অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেঈনের মতও হলো সূরা ফাতিহা না পড়া। হযরত ইমাম আবু হানিফা রহ.,হযরত ইমাম মালেক রহ. ও হযরত ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. এই তিন জন ইমাম এ ব্যপারে একমত যে মুকতাদীর জন্য সুরা ফাতিহা পড়া জরুরী নয়। তবে এ ব্যপারে ইমাম শাফেয়ী রহ. জোহর ও আসরের নামাযে কেরাত পড়া ফরজ বলে মতমত প্রকাশ করেছেন। কিন্ত বর্তমান জমানায় মাযহাব বিরোধী তথাকথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের লোকেরা এ ব্যপারে খুব বাড়াবাড়ির শিকার। সর্ব সাধারণকে তারা এ বলে ধোকা দিচ্ছে যে, সুরা ফাতিহা না পড়লে কোন মুকতাদীর নামাযই হবে না।
মুকতাদীর জন্য বিধান হলো সূরা ফাতিহা না পড়া এ সম্পর্কে দলীল প্রমাণ নিম্নে পেশ করা হল।
কুরআনের বক্তব্য:
মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে ইরশাদ করেন,
{وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوا لَهُ وَأَنْصِتُوا لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ} [الأعراف: 204]
অর্থাৎ আর যখন কুরআন তেলাওয়াত করা হয় তখন তোমরা কান পেতে অত্যন্ত মনোযোগের সাথে তা শ্রবন কর এবং নীরব থাক, যেন তোমরা রহমত প্রাপ্ত হতে পার।
এ আয়াতের ব্যাপারে পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অধিকাংশ ওলামায়ে কেরাম , ফুকাহায়ে এজাম, আইম্মায়ে মুযতাহিদীন , মুহাদ্দিসীন ও আইম্মায়ে মুফাসসিরীন তখা তাফসীর শাস্ত্রের ইমামগণের সম্মিলিত মত হচেরছ যে, উক্ত আয়াতটি নামায সম্পর্কে অবতীর্ন হয়েছে। এবং এর মাঝে মুক্তাদীগণের কর্তব্য সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ নামাযে যখন কিরাত পড়া হবে তখন মুক্তাদীর কর্তব্য হচ্ছে অত্যন্ত মনোযোগ ও একাগ্রতার সাথে ইমামের কিরাত শুবণ করা।
পাঠক! এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, আল্লাহ তা’আলা এ আয়াতে, وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ (যখন কুরআন পাঠ করা হয়।) এ অংশের পর দুটিচ শব্দ উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে – فَاسْتَمِعُوا (মনোযোগের সাথে শ্রবণ কর) আর অপরটি হচ্ছে- وَأَنْصِتُوا (এবং নীরব থাক) সুতরাং শব্দ দুটি সুস্পষ্টভাবে একথার প্রমাণ করে যে, যদি ইমাম উচ্চ আওয়াতে কিরাত পড়ে তাহলে মুক্তাদীর কর্তব্য হচ্ছে, সে মনোযোগের সাথে উক্ত কিরাত শ্রবণ করবে। আরন (দ্বিতীয় শব্দটি অর্থাৎ وَأَنْصِتُوا (নীরব থাকবে) বলার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যদি ইমাম নিম্ন আওয়াজেও কিরাত পড়ে তাহলেও মুক্তাদীগন নীরবই থাকবে, কিছুই পড়বে না।
অন্যথায় আল্লাহ فَاسْتَمِعُوا (মনোযোগের সাথে শ্রবণ করবে) বলার পর পুনরায় وَأَنْصِتُوا (এবং নীরব থাকবে) শব্দটি উল্লেখ করার কোনই অর্থ হয় না। তাই মুক্তাদী জাহরী বা (সরব) নামাযে যেরূপ নীরব থাকবে সিররী নামাযেও অনুরূপই নীরব থাকবে।
উক্ত আয়াত সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের ব্যাখ্যা
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা.) তাফসীর: সাহাবাগণের মাঝে যারা কুরআনে কারিমের শিক্ষক ছিলেন তাদের মাঝে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের (রা) নাম ছিল সর্বাগ্রে। রাসূল (সা) ইরশাদ করেন,
«اسْتَقْرِئُوا القُرْآنَ مِنْ أَرْبَعَةٍ مِنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ، وَسَالِمٍ مَوْلَى أَبِي حُذَيْفَةَ، وَأُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ، وَمُعَاذِ بْنِ جَبَلٍ»
صحيح البخاري (5/ 28)
অর্থাৎ তোমরা এই চার সাহাবা থেকে কুরআনুল কারিমের শিক্ষা গ্রহণ কর। আব্দুল্লাহ মিইবনে মাসউদ, সালেম মাওলা আবি হুযাইফা, উবাই ইবনে কাব এবং মুআয ইবনে জাবাল (রা)।
এবার আলোচ্য আয়াত সম্পর্কে এ মহান সাহাবীর তাফসীর লক্ষ্য করুন।
তাফসীরে ইবনে জারীরে বর্ণিত রয়েছে।
صلی ابن مسعود رضی اللہ عنہ فسمع انا سایقرءون مع الامام فلما انصرف قال اما ان لکم ان تفھموا۔ اما ان لکم ان تعقلوا واذا قرئ القرآن فاستمعوا لہ وانصتوا کم امرکم اللہ تعالی۔
অর্থাৎ একদা আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা:) নামায পড়ছিলেন তখন কিছু লোককে নামাযে ইমামের সাথে কিরত পাঠ করতে শুনলেন। তখন তিনি নামাযান্তে বললেন- তোমাদের এখনো কি বুঝ জ্ঞান হয়নি? যখন কুরআন পড়া হয় তখন তোমরা মনোযোগের সাথে তা শ্রবণ করবে এবং নীরব থাকবে ঠিক যেমন আল্লাহ তোমাদের আদেশ করেছেন। এই রেওয়ায়েতে তিনি সুস্পষ্টভাবে মুক্তাদীদের ইমামের পিছনে কোন কিছু পড়তে নিষেধ করে দিলেন। বুঝা গেল হযরত ইবনে মাসউদের (রা:) মতে উক্ত আয়াতটি নামাযে মুক্তাদীদের কিরাত পাঠ প্রসঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে।
মুফসসীরকুল শিরোমণি হযরত ইবনে আব্বাসের (রা তাফসীর: উবনে আব্বাস (রা:) সম্পর্কে রাসূলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন,
اللهم فقهه فى الدين و علمه التاويل
অর্থাৎ হে আল্লাহ! তুমি তাকে (ইবনে আব্বাসকে) দ্বীনের সঠিক বুঝ দান কর এবং কুরআনের সঠিক ব্যাখ্যা অনুধাবনের যোগ্যতা দগান কর।
এই মহান সাহাবী আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে বলেন,
অর্থাৎ ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত। তিনি وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ এ আয়াত সম্পর্কে বলেন যে, উক্ত আয়াতটি ফরজ নামাযের ক্ষেত্রেই অবতীর্ণ। তার এ বর্ণনা থেকেও সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আয়াতের সম্পর্ক ফরজ নামাযে কিরাত পাঠের সাথে। সুতরাং فَاسْتَمِعُوا لَهُ (কান পেতে শ্রবণ কর) এবং وَأَنْصِتُوا (নীরব থাক) বলে আয়াতে মুক্তাদীর কতব্য বলে দেয়া হয়েছে যে, তারা ইমামের কিরাত শ্রবণ করতে থাকবে এবং নীরব থাকবে।
04.09.2014
উক্ত আয়াত সম্পর্কে তাবেঈগণের ব্যাখ্যা
হাফেজ ইবনে কাছির বলেন-কুরআনুল কারিমের তাফসীরের ক্ষেত্রে কুরআন, হাদীস ও সাহাবার (রা:)পরই তাবেঈগণের তাফসীর প্রামাণ্য ও গ্রহণযোগ্য।
নবাব সিদ্দীক হাসান খাঁন সাহেব লিখেছেন, وهذا تفسير التابعى حجة অর্থাৎ এমনিভাবে তাবেঈর তাফসীর ও শরীয়তের দলীল।
হযরত মুজাহিদ ইবনে জাবর (র.) এর তাফসীর: তাবেঈগণের মধ্যে সবচেয়ে বড় মুফাস্সীর ছিলেন মুযাহিদ ইবনে জাবর (র.)। তিনি তাঁর জামানায় তাফসীর শাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ইমাম ছিলেন । তাঁর সম্পর্কে সুফিয়ান ছাউরীর (র.) েএকটি বাণী প্রসিদ্ধ রয়েছে। তিনি বলতেন, اذا جائكم التفسير عن مجاهد فحسبكم به অর্থাৎ “তোমাদের নিকট যখন মুযাহিদের (র.) তাফসীর এসে যাবে তখন তোমাদের অন্য কোন তাফসীরের প্রয়োজন হবে না।
এই প্রক্ষাত মুফাস্সীর আলোচ্য আয়াতের তাফসীরে বলেন,
عن مجاهد فى قوله تعالى: واذا قرئ القران فاستمعوا له وانصتوا في الصلوة.
অর্থাৎ মুজাহিদ (র.)বলেন যে, واذا قرئ القران আয়াতটি নামায সম্পর্কে অবতীর্ণ।
অন্যান্য বিশিষ্ট তাবেঈগণের তাফসীর: قال الضحاك رح وابراهيم النخعى رح وقتادة رح الشعبى رح والسدى رح وعبد الرحمن ابن زيد بن اسلم ان المراد بذلك الصلوة অর্থাৎ হযরত যহহাক, ইব্রাহীম নাখাঈ, কত্বাদাহ, শাবী, সূদ্দী এবং আব্দুর রহমান ইবনে যায়েদ ইবনে আসলাম (র.) প্রমুখ ইমামগণ বলেন যে, উক্ত আয়াতের মতলব হচ্ছে নামায অর্থাৎ এ আয়াত নামা সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে।
উল্লিখিত সাহাবা ও তাবেঈগণের বর্ণনা ছাড়াও আরো অনেক প্রখ্যাত মুফাস্সীরগণ যথা- তাফসীরে কাশশাফের গ্রন্থকার তাঁর কিতাবের ১ম খন্ডের ৫২৩ পৃষ্ঠায়, তাফসীরে বাইজাবীর গ্রন্থকার আল্লামা কাজী বাইজাবী ৩০৮ পৃষ্ঠায় রুহুল মা’আনীর গ্রন্থকার ৯ম খন্ডের ১৫১ পৃষ্ঠায় এবং আবুস সাউদ ৪র্থ খন্ডের ৫০৩ পৃষ্ঠায় একথঅ উল্লেখ করেছেন যে , উক্ত আয়াত নামায সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছে অর্থাৎ আয়াতের মাঝে فاستمعوا له (কান পেতে শ্রবণ করা) এবং وانصتوا (নীরব থাক) এ হুকুম মুক্তাদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে, ইমামের পিছনে সে কিছুই পাঠ করবে না।
আলোচ্য আয়াতের এ সকল নির্ভরযোগ্য তাফসীরের দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হল যে , জাহরী বা সিররী কোন নামাযেই মুক্তাদী ইমামের পিছনে কিরাত পাঠ করবে না।
হাদীসের আলোকে ইমামের পিছনে মুক্তাদরি ফাতিহা না পড়া
১ নং হাদীস: মুসলিম শরীফের ১ম খন্ডের ১৭৮ নং পৃষ্ঠায় হযরত আবূ মূসা আশ’আরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, অর্থাৎ একদা রাসূল (সা.) আমাদেরকে ওয়াজ করেন। তখন তিনি আমাদেরকে সুন্নত শিকষা দিলেন। এবং নামাযের পদ্ধতি বর্ণনা করে বললেন, যখন তোমরা নামাযে দাড়াবে তখন কাতার ঠিক করে নিবে । এরপর তোমাদেরই একজন ইমাম হবে। আর সে (ইমাম) যখন তাকবীর বলবে। তোমরাও তখন কাতবীর বলবে। তবে সে যখন কেরাত পড়বে তোমরা তখন নীরব থাকবে।
ইমাম মুসলিম (র.) তাঁর কিতাব “সহীহ মুসলিমে” হাদীসটির মানদন্ড উল্লেখকরে বলেছেন هو عندي صحيح এটি আমার নিকট বিশুদ্ধতম হাদীস।
এছাড়াও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) এবং ইমাম তবারী (র.) একে সহীহ (বিশুদ্ধ হাদীস) বলেছেন।
ইমাম তবারী তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ তাফসীরে তবারীর ৯ম খন্ডের ১১২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন।
وقد صح الخبر عن رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم من قولہ اذا قرا فانصتوا۔
অর্থাৎ রাসূল (সা.) থেকে বর্ণিত হাদীস اذا قرا فانصتوا (যখন ইমাম কিরাত পড়বে তখন তোমরা চুপ থাকবে) এটা সহীহ বা বিশুদ্ধ।
লা-মাযহাবীদের পক্ষ থেকে উক্ত হাদীসের উপর প্রশ্ন ও তার জবাব:
প্রিয় পাঠক! বর্ণিত হাদীসটি লা-মাযহাবী ভাইদের (তথাকথিত আহলে হাদীস সম্প্রদায়ের) বিপক্ষে যাওয়ায় এ দলীলটি খন্ডন করার উদ্দেশ্যে তারা এর উপর প্রশ্ন উত্থাপন করে থাকেন যে, উক্ত হাদীসের সনদে বা বর্ণনাসূত্রে রয়েছেন ক্বাতাদার ছাত্র “সুলাইমান তাইমী।” আর একমাত্র তিনিই হাদীসের এ অংশটি اذا قرا فانصتوا (ইমাম যখন কিরাত পড়ে তখন তোমরা চুপ থাক) বর্ণনা করেছেন। অন্য কারো হাদীসে এই অতিরিক্ত অংশটি পাওয়া যায় না। এতএব এ বর্ধিত অংশটি গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এর দ্বারা দলীল পেশ করাও ঠিক নয়। প্রথমেই বলা দরকার যে, আপনাদের প্রশ্ন ‘ক¦তাদার ছাত্র “সুলাইমান তাইমী” ছাড়া হাদীসের এই অংশ। اذا قرا فانصتوا (ইমাম যখন কিরাত পড়ে তোমরা তখন নীরব থাক) অন্য কোন হাদীসের পাওয়া যায় না। এ কথাই সম্পূর্ণ গলত ও ভ্রান্ত। কারণ ইমাম আবু ‘আওয়ানাহ তার গ্রন্থ সহীহ আবি আওয়ানায় উক্ত হাদীসটি এই বর্ধিত অংশ اذا قرا فانصتوا সহ বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসের সনদে রয়েছে কাতাদারই অন্য এক ছাত্র আবু উবাইদাহ। পাঠকরে অবগতির জন্য সহিহ আবি আওয়ানায় বর্ণিত হাদীসটি নি¤েœ হুবহু সনদসহ পেশ করা হল।
এই হাদীসটি সহী আবি আওয়ানায় বর্ণিত অংশ তথা اذا قرا فانصتوا (যখন ইমাম কিরাত পড়ে তোমরা তখন চুপ থাক) সহ হাদীসটি ওমর ইবনুল আমের এবং সাঈদ ইবনে আবী আরুবাহ বর্ণনা করেছেন।
তাছাড়া এহাদীসটি হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকেও সহীহ ও বিশুদ্ধ সুত্রে বর্ণিত আছে। মুসলিম, আবু দাউদ,নাসাঈ ও ইবনে মাজাহ প্রমুখ হাদীসটি উল্লেখ করেছে।
সুতরাং এসকল সহীহ গ্রন্থে হাদীসটি বর্ণিত থাকায় প্রমাণিত হল যে, আমাদের পেশকৃত হাদীসের বর্ধিত অংশ اذا قرا فانصتوا সম্পূর্ণ সহীহ।
আর আপনাদের কথা অনুযায়ী যদি মেনেও নেয়া হয় যে, “সুলাইমান তাইমী”শুধু একই এ হাদীসে اذا قرا فانصتوا অংশটি উল্লেখ করেছেন অন্য কেউই করেননি। তবুও কোন সমস্যা নেই। কারণ “সুলাইমান তাইমী’ তো সর্বসম্মতিক্রমে একজন নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত বর্ণনাকারী। আর মুহাদ্দীসগণের স্বীকৃত মূলনীতি হচেছ যে, হাদীসের মাঝে কোন নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীর অতিরিক্ত বর্ণনা বা বর্ধিত অংশ গ্রহনযোগ্য। যেমন যুগ শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দীস আল্লামা খতীব বাগদাদী রহ. বলেন,
قال الجمھور من الفقھاء واصحاب الحدیث زیادۃ الثقۃ مقبولۃ اذا انفردبھا
অর্থাৎ ফুক্বাহা ও মুহাদ্দীসিনদের নিকট (নিয়ম হচ্ছে যে,) কোন নির্ভরযোগ্য রাবী যদি একাকী হাদীসের কোন অতিরিক্ত অংশ বর্ণনা করেন(এবং অন্য কেহই ঐ অংশটি বর্ণনা না করেন) তবুও তার এই বর্ধিত অংশ গ্রহণযোগ্য।
সুতরাং সুলাইমান তাইমীর (র.) হাদীসের মাঝে অতিরিক্ত বর্ণনা যে, “ইমাম যখন কিরাত পড়ে তোমরা তখন নীরব থাক,” নি:সন্দেহে বিশুদ্ধ। এবং এ হাদীস দিয়ে দলীল দেওয়াও যথোপযুক্ত।
২নং হাদীস: হযরত যাবের (র.) থেকে বর্ণিত,
عن جابر رضی اللہ عنہ قال قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم: من کان لہ امام فقراءۃ الامام لہ قراءۃ-
অর্থাৎ হযরত যাবের (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা:) বলেন, “যে ব্যক্তির ইমাম রয়েছে(অর্থাৎ যে ইমামের পিছনে নামায পড়বে) তার ইমামের কিরাতই তার কিরাতের জন্য যথেষ্ট হবে।
এ হাদীসটি সম্পূর্ণ সহীহ এবং আমাদের মাসআলায় সর্বাধিক সুস্পষ্ট। হাদীসটির মাঝে একটি মূলনীতি বলে দেয়া হয়েছে যে, নামায (জিহরী) বা সরব হোক অথবা (সীররী) নীরব হোক সর্বাবস্থায় ইমামের কিরাতই মুক্তাদীর কিরাতের জন্য যথেষ্ট। সুতরাং মুক্তাদীর কিরাত পড়ার কোন প্রয়োজন নেই।
হাদীসটি বিভিন্ন সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এবং সনদের প্রত্যেক বর্ণনাকারীই অত্যান্ত নির্ভরযোগ্য ও বিশ্বস্ত।
আলোচ্য হাদীস সম্পর্কে শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানীর (র.) উক্তি:
নাছীরুদ্দিন আলবানী (র.) তাঁর রচিত গ্রন্থ “নবী (সা:) এর সালাত সম্পাদনের পদ্ধতি এর ৮৫ পৃষ্ঠায় আলোচ্য হাদীসটি من کان لہ امام فقراءۃ الامام لہ قراءۃ- উল্লেখ করে এর মানদন্ড ও বিশুদ্ধতা সম্পর্কে ্উক্ত পৃষ্ঠার ১ নং টীকায় লিখেছেন-
“শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ একে শক্তিশালী বলেছেন। ইবনু আবী শাইবাহ (১/৯৭/১) দ্বারাকুত্বনী, এবনু মাজাহ, ত্বাহাবী ও আহমদ একে মুসনাদ ও মুরসালভাবে অনেকসুত্রে(সনদে) বর্ণনা করেছেন।
৩নং হাদীস:
عن جابر (رض) عن النبی سلی اللہ علیہ و سلم قال من سلی رکعۃ لم یقرا فیھا بام القرآن فلم یسل الا ان یکون وراء الامام-
অর্থাৎ হযরত যাবের (রা.) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাযের এক রাকাত আদায় করে ফেলল অথচ সূরা ফাতিহা পড়ল না সে যেন নামাযই পড়ল না। তবে ইমামের পিছনে থাকলে ফাতিহা পড়বে না।
হাদীসটিকে ইমাম তিরমীযী (র.) সহীহ এবং হাসান বলেছেন। এবং ইমাম ত্বহাবী (র.) ও হাগদীসটি সহীহ, সনদে তাঁর রচিত কিতাব “শরহু মাআনীল আছারে’ উল্লেখ করেছেন। এহাদীস থেকেও সুস্পষ্ট বুঝা গেল যে, ইমামের পিছনে মুক্তাদী ফাতিহা পাঠ করবে না।
৪নং হাদীস:
عن عبد اللہ بن بحینۃ عن النبی صلی اللہ علیہ وسلم قال ھل قرا احدمنکم معی انفا قالوا نعم قال انی اقول مالی انازغ القرآن فانتھی الناس عن القراءٹ معہ حین قال ذلک۔
অর্থাৎ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে বুহাইনা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) বলেন, তোমাদের মদ্যে কেই কি এই মাত্র আমার সাথে কিরাত পড়েছে? তাঁরা বললেন হ্যাঁ, তখন রাসূল (সা.) বললেন, তাই তোম আমি ভবলা, কি ব্যাপার কিরাত নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করা হচ্ছে কেন? একথা রাসূল (সা.) যখন বললেন তখন থেকেই সাহাবায়ে কেরাম তাঁর (রাসূল সা.) এর সাথে কিরাত পড়া থেকে বিরত রইলেন।
উক্ত হাদীসে জেহরী বা সরব নামাযের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করা হয়নি। এবং লক্ষণীয় বিষয় হল যে, রাসূলের (সা.) এই কথা শ্রবণের পর থেকেই সাহাবায়ে কেরাম সকল নামাযেই ইমামের পিছনে ক্বিরাত পড়া থেকে বিরত রইলেন।
৫নং হাদীস:
عن ابی ھریرۃ (رض) ان رسول اللہ صلی اللہ علیہ و سلم قال من ادرک رکعۃ من الصلوۃ فقد ادرکھا قبل ان یقیم الامام صلبہ۔
অর্থাৎ হযরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) ইরশাদ করেন, ইমাম সোজা হয়ে দাঁড়ানোর পূর্বেই যে ব্যক্তি নামাযের একটি রুকু পেল সে পূর্ণ ঐ রাকাতটিই পেল।
এ হাদীস সম্পূর্ণ সহীহ। যার দ্বারা সুস্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে, ব্যক্তি ইমামকে রুকু অবস্থায় পেয়ে যাবে সে ঐ রাকাতটিই পূর্ণরূপে পেয়ে যাবে। অর্থাৎ তার ঐ রাকাতটি হয়ে যাবে।
আর একথা অস্পষ্ট নয় যে, ইমাম সূরা ফাতিহা পড়ার পরই রুকুতে গিয়েছেন। অথচ মুক্তাদী ঐমুহুর্তে সূরা ফাতিহা না পড়েই ইমামের সাথে রুকুতে শরীক হয়েছেন। এতদসত্যেও রাসূল (সা.) বলছেন যে, তার ঐ রাকাত হয়ে যাবে। এথেকেই সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া ফরজ নয়। যদি তাই হত তাহলে ঐ ব্যক্তির এই রাকাতটি আদায় হত না।
৬নং হাদীস:
পাঠক! হযরত আবূ বাকরা (রা.) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত বুখারীর অন্য একটি হাদীস থেকে বিষয়টি আরো সুস্পষ্ট হবে,
عن ابی بکرۃ رض انہ انتھی الی النبی صلی اللہ علیہ و سلم وھو راکع فرکع قبل ان یصل الی الصف فذکر ذلک للنبی صلی اللہ علیہ و سلم فقال زادک اللہ حرصا ولا تعد۔
অর্থাৎ হযরত আবূ বাকরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি একদা রাসূল (সা.) এর নিকট গমন করলেন। (অন্য বর্ণনায় , তিনি মসজিদে প্রবেশ করলেন। ) তখন রাসূল (সা.) কে রুকু অবস্থায় পেয়ে নামাযের কাতারে পৌছার পূর্বৈই তিনি (নিজ স্থানে) রুকুতে চলে গেলেন। (নামায শেষে) রাসূল (সা.) বলা হলে তিনি বললেন, “আল্লাহ তা’আলা (নামাযের প্রতি) তোমার আগ্রহ আরো বৃদ্ধি করুন , তবে পুনরায় এরূপ করবে না। (অর্থাৎ কাতারে শামীল না হয়ে একাকী আলাদাভাবে নামাযে দাঁড়াবে না।”){বুখারী খন্ড-১পৃ.১০৮, সুনানে কুবরা খন্ড-১ পৃ. ৯০)
এ হাদীস থেকে দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হযরত আবূ বাকরা (রা.) সূরা ফাতিহা না পড়েই রুকুতে চবলে গেলেন। অতছ তাঁর ঐ রাকাতও আদায় হয়ে গেল। এবং রাসূল (সা.) তার নামাযকে পরিপূর্ণ এবং সহীহ সাব্যস্ত করলেন। উক্ত নামায পুনরায় পড়ে নেওয়ারও নির্দেশ দিলেন না। যদি মুক্তদীর উপর সূরা ফাতিহা পড়া ফরজই হত তাহলে আবূ বাকরা (রা.) এর নামায কিভাবে সহীহ হল? আর কেনইবা রাসূল (সা.) তাঁকে নামায পুনরায় আদায় করার নির্দেশ প্রদান করলেন না? বুঝা গেকল, সূরা ফাতিহা পড়া মুক্তাদীর উপর অত্যাবশ্যক বা ফরজ নয়।
হাদীসটি যেহেতু মাযহাববিরোধী ভাইদের মতের বিপক্ষে, তাই যদি তারা তাদের মত টিকিয়ে রাখার জন্য বলেন যে, ইমাম রুকুতে গেলেও মুক্তাদী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্বিরাত পড়তে থাকবে। অথবা যদি বলেন যে, ইমামের সাথে রুকুতে পাওয়া সত্বেও সূরা ফাতিহা পাঠ না করার কারণে রাকাতটি ছুটে গেছে তাই জামা’আতের শেষে রাকাতটি পূর্ণ করে নিবে তাহলে তো এটা সম্পূর্ণরূপে বণির্ ত হাদীসের বিরোধকীতা করা হবে। যা কোন মুমিনের জন্য কখনো সম্ভব হতে পারে না।
নামাযে মুক্তাদীগণের সূরা ফতিহা পাঠ সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য ও আমল
আল্লামা বদরুদ্দিন আইনী র. তো তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ “উমদাতুল ক্বারীতে” প্রায় ৮০ জন সাহাবার আমল ও বক্তব্যের কথা উল্লেখ করেছেন যাদের কেউই ইমামের পিছনে সূরা ফাতেহা পড়ার পক্ষপাতি ছিলেন না।
নি¤েœ তাদের মধ্য থেকে কয়েকজনের ক থা উল্লেখ করা হল।
১. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের রা. ভাষ্য:
عن ابی وائل قال جاء رجل الی ابن مسعود (رض) فقال اقرا خلف الامام، قال انصت للقرآن فان فی الصلوۃ شغلا و سیکفیک ذلک الامام۔
অর্থাৎ হযরত আবু ওয়াযেল থেকে বর্ণিত যে, জনৈক ব্যক্তি ইবনে মাসউদ রা. এর নিকট এসে বলল আমি কি ইমামের পিছনে ক্বিারাত পড়বে? ইবনে মাসউদ রা. বললেন তুমি কুরআনেরন সম্মানে চুপ থাক। কেননা, নামাযে রয়েছে বিশেষ কাজ। (অর্থাৎ কুরআন শ্রবণ করা) আর তোমার জন্য উক্ত ইমামের ক্বিরাতই যথেষ্ট।
আল্লামাহ হাইছামী র. বলেন, হাদীসটি ইমাম তবরানী র. কাবীর ও আওছাতে বর্ণনা করেছেন। এবং এর সমস্ত বর্ণনা কারী নির্ভরযোগ্য।
২. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এর বক্তব্য:
مالک عن نافع ان عبد اللہ بن عمر (رض) کان اذا سئل ھل یقرءاحد خلف المام قال اذا صلی احدکم خلف الامام فحسبہ قراءۃ الامام و اذا صلی وحدہ فلیقرء قال وکان عبد اللہ بن عمر لا یقرا خلف الامام
অর্থাৎ ইমাম নাফে থেকে বর্ণনা করেন যে, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. কে যদি জিজ্ঞাসা করা হত যে, ইমামের পিছনে কি কেউ ক্বিরাত পড়বে? তাহলে তিনি বলতেন: তোমাদের মধেক্য যখন কেউ ইমামের পিছনে নামায আদাকয় করবে তখন ইমামের ক্বিরাতই তার জন্য যথেষ্ট । আর যদি কেউ একাকী নামায আদায় করে তাহলে সে যেন ক্বিরাত পড়ে। (নাফে বলেন) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) ইমামের পিছনে ক্বিরাত পড়তেন না।
৩. মুহাম্মদ ইবনে আজলান বলেন:
قال علی (رض) من قرا مع الامام فلیس علی الفطرۃ
অর্থাৎ হযরত আলী (রা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ইমামের সাথে সাথে ক্বিরাত পড়ে সে পৃকৃত স্বভাব বিরোধী কাজ করে।
৪. আতা ইবন ইয়াসার:
وعن عطاء بن یسار انہ سئل زید بن ثابت (رض( عن القراءۃ مع الامام فقال: لا قراءۃ مع الامام فی شئ(روہ مسلم فی باب سجود التلاوۃ)
অর্থাৎ আতা ইবন ইয়াসার থেকে বর্ণিত। তিনি হযরত যায়দ ইবনে ছাবেত (রা.) কে জিজ্ঞেস করেছিলেন ইমামের সঙ্গে কেরাত পড়া সম্পর্কে। উত্তরে তিনি বলেছেন- ইমামের সঙ্গে কোন রকম কেরাত পড়া যাবে না। (মুসলিম শরীফ)
তাহাবী শরীফে বিশুদ্ধ সূত্রে হযরত ইবন উমর ও জাবির (রা.) থেকেও অনুরূপ ফতওয়া উল্লেখ করা হয়েছে। (দ্র. আসারূস সুনান, পৃ.১১৬)
وعن عطاء بن یسار انہ سئل زید بن ثابت (رض( عن القراءۃ مع الامام فقال: لا قراءۃ مع الامام فی شئ(روہ مسلم فی باب سجود التلاوۃ)
৫. আবূ জামরা বলেন:
عن ابی جمرۃ: قلت لابن عباس اقرا والامام بین یدی فقال: لا (رواہ الطحاوی)
অর্থাৎ আবূ জামরা বলেন, আমি ইবনে আব্বাস (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, ইমাম যখন আমার সামনে থাকবেন তখন কি আমি কেরাত পড়ব? তিনি বললেন, না। (তাহাবী শরীফ)
হাদীসটির সনদ হাসান। ( আসারুস সূনান, পৃ:১১৬)
৭০ জন বদরী সাহাবার আমল:
قال الشعبی ادرکت سبعین بدریا کلھم یمنعون المقتدی عن القراۃ خلف الامام۔
অর্থাৎ ইমমি শাবী (র.) বলেন আমি ৭০ জন বদরী সাহাবী পেয়েছি। তাঁদের প্রত্যেকেই মুক্তাদীকে ইমামের পিছনে ক্বিরাত পড়া থেকে বাঁধা প্রদান করতেন।
সুতরাং , ৭০ জন বদরী সাহাবী ও উল্লিখিত বিশিষ্ট সাহাবাগণের আমল এবং বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, সাহাবায়ে কিরাম ও ইমামের পিছনে ক্বিরাত না পড়ার প্রবক্তা ছিলেন।
তাবেঈগণের আমল
১. হযরত আলক্বামা ইবনে ক্বায়সের আমল:
عن ابراھیم قال ما قرا علقمۃ بن قیس قط فیما یجھر فیہ ولا فیما لا یجھر فیہ ولا فی الرکعتین الاولیین ولا فی الاخرتین ام القرآن و لا غیرھا خلف الامام۔
অর্থাৎ হযরত ইব্রাহীম নাখাঈ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-হযরত আলক্বামা ইবনে কায়স কখনো ইমামের পিছনে ক্বিরাত পড়তেন না। জেহরী(সরব) নামাযেও না এবং সিররী (নীরব) নামাযেও না। প্রথম দুই রাকাতেও না শেষের দুই রাকাতেও না। সূরা ফাতেহাও না বা অন্য কোন সূরাও না।
হাদীসটির সনদ খুব মযবুত।
২. আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদের সতর্কবাণী:
عن الاسود قال وددت ان الذی یقرا خلف الامام ملی فاہ ترابا۔
অর্থাৎ হযরত আসওয়াদ থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন আমার ইচ্ছে হয় যে, যে ব্যক্তি ইমামের পিছনে ক্বিারআত পড়ে তার মুখ মাটিতে পূর্ণ হয়ে যাক।
আল্লামা ওসমানী লিখেন যে, এ হাদীসের সনদ সহীহ। এর সনদে উল্লিখিত রাবীগণ থেকে অনেক মুহাদ্দিস হাদীস বর্ণনা করেছেন। এছাড়াও আনো অনেক তাবেঈনদের কথা সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যারা ইমামের পিছনে ক্বিরআত পড়তেন না। উল্লিখিত তাবেঈনের আমল দ্বারাও সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে, তাঁদের আমল ও মাযহাব ছিল ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা না পড়া।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের উক্তি
আল্লামা ইবনে কুদামা মুগনী গ্রন্থে ১ম খন্ডের ৬০২ নং পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন:
قال احمد: ما سمعنا احدا من اھل الاسلام یقول ان الامام اذا جھر بالقراءۃ لا تجزی صلوۃ من خلفہ اذا لم یقرء۔ وقال ھذا النبی صلی اللہ علیہ و سلم و اصحابہ و التابعون، وھذا مالک فی اھل الحجاز و ھذا الثوری فی اھل العراق وھذا الاوزاعی فی اھل الشام وھذا الیث فی اھل مصر ماقالوا الرجل صلی خلف الامام قرء امامہ و لم یقراھو صلوتہ باطلۃ۔
অর্থাৎ ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বাল (র.) বলেন- আমরা আহলে ইসলাম তথা মুসলমানদের কাউকেই বলতে শুনিনি যে, ইমাম উচ্চস্বরে ক্বিরাত পড়ল অথচ তার পিছনে মুক্তাদীগণ ক্বিারাত না পড়ার কারণে তাদের নামায যথেষ্ট হল না। তিনি আরো বলেন যে,এই তো নবী, (সা.) তাঁর সাহাবী ও তাবেঈগণ, হিজাজের অধিবাসী ইমাম মালেক (র.) ইরাকে ইমাম সাউরী, (র.) শামে ইমাম আওয়াজাঈ (র.) মিশরে ইমাম লাইস (র.) তাঁরা কেউ একথা বলেননি ওয, কোন ব্যক্তি ইমামের পিছনে নামায পড়ল আর ইমাম ক্বিারআত পড়ল কিন্তু সে কেরাত পড়ল না তাহলে তার নামায বাতিল হয়ে যাবে।
ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠের সপক্ষে
মাযহাববিরোধীদের দলীল ও তার জবাব
১নং হাদীস ও তার জবাব:
وعن عطاء بن یسار انہ سئل زید بن ثابت (رض( عن القراءۃ مع الامام فقال: لا قراءۃ مع الامام فی شئ(روہ مسلم فی باب سجود التلاوۃ)
অর্থাৎ হযরত উবাদা ইবনে সামেত থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতেহা পড়ল না তার নামাযই হল না। (বুখারী , মুসলিম) এবং মুসলিমের এক বর্ণনায় রয়েছে“যে ব্যক্তি উম্মুল কুরআন (ফাতিহা) পড়ল না।
তাদের পেশকৃত এ হাদীসটি নি:সন্দেহে সহীহ হাদীস এবং বুখারী ও মুসলিম উত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত রয়েছে।
কিন্তু কুরআনের সুস্পষ্ট আয়াত ও অন্নান্য একাধিক সহীহ । হাদীসের আলোকে প্রতিয়মান হয় যে, উক্ত হাদীসটি শুধু একাকী ামায আদায়কারী (মুনফারিদ) এবং ইমামের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। মুক্তাদীর ক্ষেত্রে কখনো প্রযোজ্য নয়।
আমরা আমাদের এ ব্যাখ্যার সমর্থন পাই ইমাম তিরমিযী (র.) এর বর্ণনা থেকে। তিনি সুনানে তিরমিযীর ১ম খন্ডের ৭১ পৃষ্ঠায় ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের একটি বর্ণনা উল্লেখ করেন
واما اھمد بن حنبل فقال معنی قول النبی صلی اللہ علیہ و سلم لا صلوۃ لمن لم یقرء بفاتحۃ الکتاب اذا کان وحدہ واحتج بحدیث جابر بن عبد اللہ (رض) حیث قال من صلی رکعۃ لم یقرء فیھا بام القراًن فلم یصل الا ان یکون وراء الامام۔ قال احمد فھذا رجل من اصحاب النبی سلی اللہ علیہ وسلم تاول قول النبی سلی اللہ علیہ وسلم لا صلوۃ لمن لم یقرء بفاتحۃ الکتاب ان ھذا اذا کا وحدہ۔
অর্থাৎ ইমাম তিরমিযী বলেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র.) বলেন: রাসূল (সা:) এর বার্ণী “যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করল নাতার নামায হবে না।” ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে ব্যক্তি একাকী নামায আদয় করে।
তিনি (আহমদ) একথার সপক্ষে দলীল পেশ করেন হযরত যাবির (রা.) এর হাদীস দিয়ে যে, তিনি বলেছেন যে ব্যক্তি এক রাকাত নামায আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা পড়ল না তার নামাযই হল না, হ্যা তবে ইমামের পিছনে থাকলে ফাতিহা পড়বে না।”
তিনি আরো বলেন যে, এই তো রাসূল (সা.) এর এক সাহাবী যিনি রাসূল (সা.) এর বাণী “ যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পড়ে না তার নামায হয় না” এর উদ্দেশ্য বুঝে নিলেন যে এটি একাকী নামায আদায়কারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বলের এই বক্তব্য দ্বারাও স্পষ্ট হয়ে গেল যে, হাদীসটি মুক্তাদীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় । সুতরাং এ হাদীস এবং এধরনের হাদীস সহীহ হলেও এর দ্বারা মুক্তাদীর উপর ফাতিহা পড়ার হুকুম সাব্যস্ত করা যায় না।
২. হাদীস ও তার জবাব:
عن عبادۃ بن الصامت (رض) قال صلی رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم الصبح فثقلت علیہ القراءۃ فلما انصرف قال انی اراکم تقرۃون وراء امامکم قال قلنا یا رسول اللہ ای وللہ قال لا تفعلوا الابام القرآن فانہ لاصلوۃ لمن لم یقرءبھا۔
অর্থাৎ হযরত উবাদা ইবনে ছামিত (রা.) থেকে বর্ণিত যে, একদা রাসূল (সা.) ফজরের নামায আদকয় করছিলেন। তখন আমাদের ক্বিরাআতের কারনে তার কিরাত পড়তে অসুবিধার সৃষ্টি হয়। অতপর নামায শেষে আমাদেরকে বললেন সম্ভবত তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে ক্বিরাআত পড়েছ? তিনি বলেন, আমরা বললাম হ্যাঁ ইয়া রাসূলাল্লাহ! (সা.) তখন তিনি বললেন: তোমরা এরূপ করবে না, তবে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে কেননা, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার নামায হয় না।
উক্ত হাদীস থেকে বুঝা যাচ্ছে সে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
তবে হাদীসটি মোটেই সহীহ নয়। এটি সনদ ও মতন উভয় দিক থেকেই দোষ-ক্রুটি যুক্ত। শাইখুল ইসালাম ইমাম ইবনে তাইয়িশ্যাসহ ইমাম আহমদ, হাফেজ ইবনে আব্দুল বার, এবং আরো বড় বড় মুহাদ্দিসীনে কেরাম হাদীসটিকে অতি দুর্বল সাব্যস্ত করেছেন।
এ হাদীস সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়্যার বক্তব্য দেখুন । তিনি তাঁর প্রন্থ “ফাতওয়া ইবনে তাইমিয়্যা” ২৩ তম খন্ডের ২৮৭ পৃষ্ঠায় উণেøখ করেন-
وھذا الحدیث معلل عند ائمۃ الحدیث بامور کثیرۃ ضعفہ اھمد وغعرہ من الائمۃ وقد بسط الکلام علی ضعفہ فی غیر ھذا الموضع۔
অর্থাৎ
হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের নিকট এ হাদীসটি বিভিন্ন কারণে এবং বিভিন্ন দিক থেকে দোষ-ক্রুটি য্ক্তু। ইমাম আহমদ সহ অন্যান্য ইমামগণ এটিকে দুর্বল (যয়িফ) সাব্যস্ত করেছেন। এহাদীসের দুর্বলতা ও অগ্রহনীয়তা সম্পর্কে অন্য স্থানে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে।
৩নং হাদীস ও তার জবাব:
عن ابی ھریرۃ (رض) عن النبی صلی اللہ علیہ وسلم انہ قال من صلی صلوۃ لم یقرا فیھا بام القرآن فھی خداج ثلاثا غیر تمام فقیل لابی ھریرۃ (رض) انا نکون وراء الامام فقال اقرء بھا فی نفسک۔
অর্থাৎ হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেন, রাসূল(সা:) বলেছেন যে ব্যক্তি নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার নামায অসম্পূর্ণ (একথা তিনি তিনবার বললেন। এর পর আব হুরাইরাকে বলা হল আমরা ইমামের পিছনে থাকলে কি করব? তিনি বললেন – তা মনে মনে পড়ে নিবে।
পাঠক! হাদীসটির প্রতি লক্ষ করুন। এ হাদীসে দুটি অংশ রয়েছে। প্রথম অংশে শুধু এতটুকু বর্ণিত হয়েছে যে,“ফাতিহা ছাড়া নামায পূর্ণ হয় না।”
এবং এতটুকুই হচ্ছে রাসূল (সা:) এর বাণী।
আর দ্বিতীয় যে অংশটি রয়েছে সেটি হচ্ছে আবূ হুরাইরা (রা.) এর ফতোয়া বা ইযতিহাদ। সুতরাং প্রথম অংশ, যা রাসূল (সা.)থেকে মারফু” হিসেবে বর্ণিত যে, ফাতিহা ছাড়া নাময হবে না, তা কুরআন ও অন্যান্য সহীহ হাদীসের আলোকে একাকী নামাযী ও ইমামের জন্য প্রযোজ্য।
আর দ্বিতীয় অংশটি যেহেতু আবু হুরাইরা (রা.) এর নিজস্ব ইজতিহাদ। তাই এটি (মুহাদ্দিসগণের মূলনীতির ভিত্তিতে) রাসূলের (সা.) অন্যান্য সরাসরী হুকুমের মোকাবেলায় দলীল রূপে সাব্যস্ত নয়। সুতরাং এ হাদীসটি দিয়েও দলীল পেশ করা সম্ভব নয়।
পরিশেষে আমরা শাইখুল ইসলাম হাফেজ ইবনে তাইমিয়্যা (র.) এর একটি উক্তি :
فالنزاع من الطرفین لکن الذین ینھون عن القراءۃ خلف الامام جمھور السلف و الخلف ومعھم الکتاب و السنہ الصحیحۃ
অর্থাৎ উভয় পক্ষেরই মতানৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। তবে যারা বলেন যে, ইমামের পিছনে ক্বিরাত পড়া যাবে না তারা হলেন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী ওলামায়ে কেরামগণের একটি বিরাট অংশ এবং সপক্ষে রয়েছে আল্লাহর কিতাব এবং সহীহ হাদীস সমূহ।

শেয়ার করুন

0 Comments:

একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!