যুগে যুগে আল্লাহ পাক মানুষের কল্যাণের জন্য দীনের বুলন্দির জন্য সর্বোপরি উভয় জাহানে মানবজাতির আলোকবর্তিকারূপে যাঁদের পাঠিয়েছেন যারা পৃথিবীতে কায়েম
করেছেন ‘মা আনা আলাইহি ওয়া আসহাবী’ র উজ্জল দৃষ্টান্ত মানুষকে দিয়েছেন সেই অনুপম আদর্শের দীক্ষা তাদেরই অন্যতম ছিলেন হজরত মাওলানা ইউসুফ কান্ধলবী রহঃ ।
জন্ম ও বংশ : তিনি ২৫ জুমাদাল-উলা ১৩৩৫ হিজরী মোতাবেক ২০ মার্চ ১৯১৭ ইং রোজ বুধবার ভারতবর্ষের উত্তর প্রদেশের মুযাফফর নগর জেলার কান্ধলা নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিশ্ব তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা ইলিয়াস রহঃ। দাদা হজরত মাওলানা ইসমাঈল রহঃ, শায়েখ যাকারিয়া রহঃ এর চাচাত ভাই।
শৈশব ও বাল্যকাল : ছোটকাল থেকেই তিনি একটি দ্বীনি ও ইলমী পরিবেশে লালিত পালিত হন। তাঁর পরিবারের শুধু পুরুষ নয় বরং মহিলারাও তাকওয়া- পরহেযগারীতে মশহুর ছিলেন। পরিবারের সকলেই ছিলেন হাফেজে কুরআন।
হিফজুল কুরআন : মাত্র ১০ বছর বছরেই হজরতজী পুরো কুরআন মজীদ মুখস্থ করে ফেলেন। মেওয়াত শহরে হজরত মাদানী রহঃ এর বড় ভাই হযরত মাওলানা সায়্যেদ আহমদ মাদানী রহঃ মদীনা থেকে হযরতজীর জন্য কুরআন হিফজের সার্টিফিকেট পাঠিয়ে দেন। ছোটবেলা থেকেই তাঁর প্রতি বিশিষ্ট বুজুর্গদের নেক দৃষ্টি ও স্নেহ মুহাব্বত ছিল। বিশেষ করে হজরত মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী রহঃ তাঁকে নিজ পুত্রের মত আদর করতেন। হজরতজীও তাঁকে আব্বা আব্বা বলেই ডাকতেন।
প্রাথমিক শিক্ষা : হিফজ শেষ করার পর হযরতজী ১১ বছর বয়সে নিজ পিতার কাছে আরবী পড়া শুরু করেন। সর্বপ্রথম মীযান মুনশাইব পড়েন এবং মাত্র ১৫-২০ দিনেই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আয়ত্ব করে ফেলেন। এরপর সরফেমীর, পাঞ্জেগাঞ্জ অন্যান্য শিক্ষকদের কাছে পড়েন। এরপর পিতাজান স্বীয় আবিষ্কৃত পদ্ধতিতে তাকে নাহবেমীর পড়ান। এরপর কাসিদায়ে বুরদা, চেহেল হাদীস ইত্যাদি কিতাব পড়ান। শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়া রহঃ এর নিকট সুনানে আবূ দাউদ পড়েন। মাজাহেরুল উলূম মাদ্রাসায় মাওলানা আব্দুল লতীফ সাহেবের নিকট সহীহ বুখারী পাঠ করেন।
শিক্ষার প্রতি আগ্রহ : মাতা-পিতার উন্নত শিক্ষার ফলে হযরতজী অন্যান্য ছেলেদের মত খেলাধুলার পিছনে অনর্থক সময় নষ্ট করতেন না। অযথা কোন কথা বা কাজের সাথে তাঁর কোন সম্পর্কই ছিল না। হযরতজীর বাল্যসাথী মাওলানা ইদরীস আনসারী বলেন যে ‘আমি তিন বছর তাঁর অত্যন্ত
ঘনিষ্ঠ সাথীদের মধ্যে একজন ছিলাম, কিন্তু কখনোও তাঁকে বাজারে ঘুরতে দেখিনি’। আল্লাহ পাক তাঁকে পরবর্তী জীবনে মহান ব্যক্তি বানাবেন, সেজন্য বাল্যকালে
তাঁকে ভালো কাজেই শুধু মশগুল করে রেখেছিলেন। তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবনী বিষয়ক কিতাবাদীদের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল ছিলেন।
তিনি নিজেই বলেন – আমি পয়সা জমা করার জন্য একটি ডিব্বা বানিয়েছিলাম। যা কিছু পয়সা হাতে আসতো তা এ ডিব্বায় রেখে দিতাম। উদ্দেশ্য ছিল এ জমাকৃত অর্থ দিয়ে সীরাতের কিতাব ক্রয় করবো। সীরাতের প্রতি এমনই ছিল তাঁর ভালোবাসা।
অপরের উপর ভরসার ঘৃণা : বাল্যবেলা থেকেই তিনি মানুষের কাছে কিছু চাইতে লজ্জাবোধ ও ঘৃনাবোধ করতেন, অন্যদেরকেও তা করতে নিষেধ করতেন। মিহরাব খান মেওয়াতী রহঃ এ প্রসঙ্গে নিজ ঘটনা বর্ণনা করেন যে, যখন হযরতজীর বয়স প্রায় ১০ বছর একদিন তিনি রুটি খাচ্ছিলেন, আমি বললাম যে ভাই আমার জন্য আরেকটা রুটি নিয়ে এস। তখন তিনি নিষ্পাপ কণ্ঠে বললেন, ভাই কারো কাছে চাইতে হয় না।
মেহমান নাওয়াজী : দিল্লীর নিজামুদ্দীনে সব সময় মেহমান আসতেই থাকতো। হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহঃ সর্বদা মেহমানদের সঙ্গেই খানা থেতেন। হযরতজীর বয়স যখন ১২/১৩ বছর তখন থেকেই হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহঃ স্থীয় পুত্রের হাতে মেহমানদের সেবার দায়িত্ব অর্পণ করেন। হযরতজী প্রত্যহ বাসা থেকে খাবার নিয়ে
আসতেন এবং সবার খাওয়া শেষ হলে প্লেট-বর্তন নিয়ে যেতেন। নিজামুদ্দীনে কাশিফুল উলূম মাদ্রাসায় ছাত্রদের খাবার রান্না করার নির্দিষ্ট কোন ব্যবস্থা ছিল না। ধারাবাহিকভাবে সব ছাত্রই খাবার পাকাতো। হযরতজী রহঃ নিজেও এ কাজে শরীক হতেন। ছাত্রদের সাথে আটা পিষতেন, মসলা বাটতেন এবং জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে আনতেন।
কর্মজীবন : শিক্ষাজীবন সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি পাঠদানে মনোনিবেশ করেন। আবূ দাউদ শরীফের দরস দেয়া আরম্ভ করেন এবং বহু বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত রাখেন। পিতা তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হওয়া সত্ত্বেও তাবলীগের চাইতে দরস-তাদরীসের প্রতিই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। বিভিন্ন জামাতের সাথে অল্পকিছু সময় দিলেও পিতা যেমনটা তাঁর কাছে চাইতেন অতটা প্রত্যাশা তিনি পূরণ করতে পারেন নি। পিতার ইন্তেকালের পর তাবলীগের মুরুব্বীরা তাঁর মাথায় আমীরের পাগড়ী পড়িয়ে দেন। তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাবলীগ ও দাওয়াতের মেহনতের কাজে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। বলা হয় তিনি দিনে ১৮ ঘণ্টা নিজামুদ্দিনে বয়ান করতেন।
একবার ডাক্তার তাঁকে বললেন, হযরত আপনি আরেকটু কম সময় বয়ান করেন। নইলে আপনার কণ্ঠের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তিনি বললেন, কণ্ঠ ভালো রাখার জন্য যদি আমাকে আল্লাহর কথা বলা থামিয়ে দিতে হয়, সেই কণ্ঠ দিয়ে আমি কী করবো ? মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর সময় তাবলীগের কাজ শুরু হলেও সেটা তখনো বৈশ্বিক রূপ ধারণ করেনি। অল্পকিছু হলেও সেটা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। হযরতজীর সময়ে তাবলীগের ও দাওয়াতের মেহনত বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে শুরু হয়। দিনব্যাপী তাবলীগের কাজে এত সময় দেয়ার পরও ফাঁকে ফাঁকে তিনি তাসনীফাত তথা লেখালেখির কাজও করতেন। তাঁর যে তিনটি রচনা বিশ্বজুড়ে মাকবুল ও সমাদৃত হয়েছে সেগুলো হচ্ছে –
#আমানিল আহবার – বিখ্যাত হাদীসের কিতাব শরহু মা’আনিল আছারের ভাষ্যগ্রন্থ।
#হায়াতুস সাহাবা – সাহাবায়ে কেরামের জীবনালেখ্য।
#মুন্তাখাব হাদীস – তাবলীগ জামাতের ছয় নম্বর সম্পর্কিত নির্বাচিত হাদীসসমূহ, তার তরজমা ও ব্যাখ্যা।
তাঁর সম্পর্কে শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী রহঃ বলেন – তিনি এক বছরের কাজ করেন এক মাসে, এক মাসের কাজ করেন এক সপ্তাহে, আর এক সপ্তাহের কাজ করেন এক দিনে।
ওফাত: জীবনের বেশিরভাগ চিল্লা তিনি পাকিস্তানে কাটিয়েছেন। সেই পাকিস্তানেই সফর করাকালীন অবস্থায় ২৯ জিলকদ ১৩৮৪ হিজরী মোতাবেক ২ এপ্রিল ১৯৬৫ ইং এই মহামনীষী অল্প বয়সেই ইহধর্ম ত্যাগ করেন। তাঁর জীবন ছিল রাসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সীরাত অনুসরণের যথার্থ দৃষ্টান্ত। আল্লাহ তাঁকে শায়ানে শান জাযা দান করুন। আমিন।
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!