ধর্ম কী? এটি হচ্ছে মানুষের জন্য জীবনবিধান যা আল্লাহ তা‘আলা নবী-রাসূলগণের মাধ্যমে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। আল-কুরআন হচ্ছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর মাধ্যমে নাযিলকৃত জীবনবিধান। অথচ আমরা মুসলমানরা ধর্ম বলতে সাধারণত নামায, রোযা, বে-বুঝ কুরআন তিলাওয়াত এবং হাদীসে উদ্ধৃত দু‘আ-দরূদের আমল করাকেই বুঝে থাকি।
কুরআনের জ্ঞানের অভাব এবং ভুল শিক্ষার কারণে আমাদের অধিকাংশ মুসলিম আজ কুরআনের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে নানা প্রকার ভ্রান্ত আমলে লিপ্ত রয়েছে। এর ফল স্বরূপ আমাদের সকল আমল বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন, ‘তুমি বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের পরিচয় বলে দেব না, যারা আমলের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত! তারা ওইসব লোক, দুনিয়ার জীবনে যাদের প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে, অথচ তারা মনে করে তারা সৎ কাজ করছে।’ (১৮:১০৩-১০৪)
আমাদের আমল ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, ভুল শিক্ষার কারণে ৩টি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। তা হচ্ছে—
১. কুরআনের মূল্যায়নে ব্যর্থতা,
২. হাদীসের গুরুত্ব,
৩. রাসূল (সা.)-এর মর্যাদা ও তাঁর প্রতি ভালোবাসা।
১. কুরআনের মূল্যায়নে ব্যর্থতা
কুরআন হচ্ছে ইসলামের মূল পাঠ্যপুস্তক বা টেক্সট বই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ কুরআন ‘মানুষের জন্য হিদায়াত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।’ (সূরা বাকারা: ১৮৫)
‘এ কুরআন এক বরকতময় কিতাব যা আমি তোমার (রাসূল) প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষেরা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে ও বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (৩৮:২৯)
‘এ কুরআন মানুষের জন্য সুস্পষ্ট দলিল এবং দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমত।’ (৪৫:২০)
‘এ কুরআন সমগ্র জগতের জন্য উপদেশ ব্যতীত কিছুই নয়।’ (৬৮:৫২)
অথচ কুরআনের উপদেশ গ্রহণের আগ্রহ আমাদের মধ্যে নেই। যেহেতু আমাদের অধিকাংশের ধারণা সহীহ উচ্চারণে (যা চালু হয় রাসূলের পরের যুগে) অর্থ ও মর্ম না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত হচ্ছে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য। আর ইবাদতের জন্য হাদীসের অনুসরণ ও বাস্তবায়ন যথেষ্ট।
আসলে কুরআনের বিধি বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করাটাই হচ্ছে কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য। কেবল অর্থ বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করলে অর্থাৎ পড়লে এবং সে অনুযায়ী আমল করলে আল্লাহর রহমত অর্জন সম্ভব। না বুঝে পড়া সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যই হলো বুঝে পড়া।’ (বুখারী ও মুসলিম)
কুরআন বুঝে পড়তে হলে সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াতে প্রদত্ত দিকনির্দেশনার অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ মুহকাম (সুস্পষ্ট) এবং মুতাশাবিহ (রূপক) আয়াতের গুরুত্ব অনুধাবন এবং তার সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রণয়নকৃত ও নাযিলকৃত আমাদের জীবনবিধান। এ বিধান অনুযায়ী জীবন গড়া বা না গড়া ও তার পরিণাম সম্পর্কিত বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে কুরআনে ব্যক্ত করা হয়েছে, যার অতিরিক্ত কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কেননা এগুলোই হচ্ছে মুহকাম আয়াত। তাছাড়া কুরআনে বিভিন্ন নবীর জীবনী, তাদের দায়িত্ব, আল্লাহ প্রদত্ত মুজিজা ও মর্যাদা এবং কওমের উত্থান-পতনের ঘটনা নানাভাবে বার বার বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে মানুষ তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে (১৭:৪৯)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা সম্ভব। তাই সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াতে এ সকল আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা পরিহারের কথা বলা হয়েছে।
সুধী পাঠক, আল কুরআন না বুঝে পড়ার ফলেই মুসলমানরা আজ প্রকৃত সত্য এবং প্রকৃত শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। অথচ কুরআন বুঝে তা বাস্তবে প্রয়োগের ফলেই আল্লাহ তা‘আলা স্বর্ণযুগের মুসলমানদের দিয়েছিলেন পৃথিবীর কর্তৃত্ব। এই কর্তৃত্ব প্রদান সর্ব যুগের জন্য প্রযোজ্য। (দেখুন আল কুরআন ২৪:৫৫)
কুরআন বুঝতে হলে যে কোনো পাঠ্যপুস্তকের মতই তা নিজ ভাষায় বুঝে অধ্যয়ন করতে হবে। নিজ ভাষায় অধ্যয়ন করলে এর উপদেশবাণী হাদীস ও তাফসীরের সাহায্য ছাড়াই অনুধাবন সম্ভব। কুরআন বুঝা শুধু ধর্মীয় আলেম ও ইমাম সাহেবদের কর্তব্য নয়। এর বিধি বিধান জানা ও মানা সকল মুসলমানের জন্য ফরয। তাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআন বুঝা সহজ করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, ‘আমি তো তোমার ভাষায় কুরআন সহজ করে দিয়েছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (৪৪:৫৮)
কুরআন আরবীতে নাযিল হওয়ার একমাত্র কারণ, এটা ছিল রাসূলের মাতৃভাষা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার নিজ জাতির ভাষা-ভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের জাতির কাছে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করার জন্য। (১৪:৪, ৪১:৪৪) এখানে উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা.) নিজেও অনুবাদকের মাধ্যমে অন্যান্য ভাষা-ভাষীদের কাছে তাদেরই মাতৃভাষায় কুরআনের বাণী পৌঁছিয়েছেন।
সুধী পাঠক, একটু ভেবে দেখুন, কুরআন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশি পঠিত কিতাব। প্রতিনিয়ত কুরআন তিলাওয়াত ছাড়াও আমরা প্রতিদিন কুরআনের আয়াতের সাহায্যে নামায আদায় করি, দু‘আ করি। বিপদে-আপদে, অসুখে-বিসুখে এবং অন্যান্য প্রয়োজনে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত কামনা করি। অথচ দুঃখের বিষয় হলেও এটা কি সত্যি নয় যে, আমাদের অধিকাংশ যা পড়ছে বা তিলাওয়াত করছে, তার কিছুই তারা বুঝে না?
কুরআনের জ্ঞান আপনার ধর্মীয় চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দিবে, যা আপনার ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি এবং হাদীসের বক্তব্যের সঠিকতা নির্ণয়ে সহায়ক হবে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা এবং নিজেদের প্রিয়জনকে এ উপদেশ দেয়া আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘যারা জ্ঞান রাখে আর যারা রাখে না, তারা কি কখনো সমান হতে পারে? (৩৯:৯)
রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।’ (বুখারী ও মুসলিম)
কুরআনের মৌলিক শিক্ষা
১. এক আল্লাহর একত্ব, সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে। (১:৪, ৯৮:৫)
২. নবী-রাসূল ও সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর দাস, সুতরাং মানুষের মনগড়া আইন নয় বরং আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করতে হবে। (২৮:৭০, ৮৮, ৫:৭২)
৩. কুরআন ও সহীহ হাদীস বহির্ভূত আমল পরিত্যাগ করতে হবে।
৪. সকল কাজ ও ইবাদতে নবীর অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হবে। (৪:৮০)
২. হাদীসের গুরুত্ব
হাদীস হচ্ছে মূলত আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রন্থ বা নোট বই এবং সুন্নাত ও নফল (অতিরিক্ত) আমলের সূত্র।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, ‘ওরা তোমার নিকট কোনো সমস্যা নিয়ে এলে আমি তোমাকে তার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকি।’ (২৫:৩৩) ‘তার বিশদ ব্যাখ্যা করে দেয়ার দায়িত্বও আমার।’ (৭৫:১৯)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘সে (রাসূল) নিজের ইচ্ছামত কোনো কথা বলে না (ধর্মীয় বক্তব্য দেয় না), সে যা বলে সবই আল্লাহর ওহী।’ (৫৩:৩-৪)
রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমার নিকট ওহীর মাধ্যমে যা নাযিল হয়, আমি শুধু তারই অনুসরণ করি।’ (৬:৫০, ৭:২০৩, ১০:১৫ এবং ৪৬:৯)
উপরিউক্তি আয়াতগুলো পর্যালোচনা করে এটা সহজেই বলা যায় যে, হাদীসের সকল বক্তব্য আল্লাহর বাণী যা রাসূল (সা.) নিজ ভাষায় ব্যক্ত করেতেন। সুতরাং কুরআন হাদীস বহির্ভূত বক্তব্য বা আমল ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। বরং তা বিদআত। মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তানের অপচেষ্টা। এ সত্য উপলব্ধি করলে সহজেই শিরক ও বিদআতমুক্ত আমল করা সম্ভব।
হাদীস গ্রন্থগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাবো যে, রাসূল (সা.) কেবল কুরআনের ব্যাখ্যাই দেননি। তিনি যেভাবে কুরআন বাস্তবায়ন করেন তার বিস্তারিত বিবরণও এর অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া তিনি তার সাহাবীদের বিভিন্ন সময়ে নফল আমল ও তার ফযীলতের কথাও জানিয়েছেন। অবশ্য রাসূল (সা.) বুঝতে পেরেছিলেন যে, নও মুসলিমরা কুরআনের জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে সেসব ফযীলতের আমলকে প্রাধান্য দেবে। তাই তিনি তার জীবদ্দশায় কুরআনের শিক্ষা বিস্তারের পূর্বে এ সকল আমলের কথা লিখতে এবং জনসাধারণের কাছে তার প্রচার নিষেধ করেছেন।
রাসূলের এ নিষেধবাণী উপেক্ষা করে, কুরআনের জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে কেবল হাদীসের অনুসরণের ফলে মুসলিমরা আজ পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত আমলে লিপ্ত।
অল্প চেষ্টায় অধিক লাভের আশা করা মানুষের চারিত্রিক দুর্বলতা। রাসূলের পরবর্তী যুগে মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসলামের শত্রু কতিপয় মিথ্যুক হাদীস বর্ণনাকারী ও স্বার্থপর আলেমরা সাহাবীদের উদ্ধৃতি দিয়ে লক্ষ লক্ষ জাল হাদীসের প্রচলন ও প্রচার আরম্ভ করে। মুসলমানেরা এই সকল হাদীসের অনুসরণ করে বিপথগামী হতে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফাযতের ঘোষণা দেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।’ (১৫:৯) দুর্ভাগ্যবশতঃ হাদীস সংরক্ষণে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর ন্যায় হাদীসশাস্ত্রেও নানা প্রকার বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। হাদীস বিশারদদের দ্বারা স্বীকৃত ১নং সহীহ হাদীস গ্রন্থের সংকলনকারী ইমাম বুখারী (রহ.) ১০ (দশ) লক্ষের অধিক হাদীস সংগ্রহ করে নির্ভরযোগ্যতার ১৮টি পন্থায় যাচাই-বাছাই করে সর্বমোট মাত্র ৭,৩৯৭টি হাদীস সহীহ বুখারী শরীফের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা ছিলো ১%-এর কম, বাকি ৯৯ শতাংশের বেশি মিথ্যা বা সঠিক নয় বলে পরিত্যাগ করেন। অবশ্য সহীহ বলে গৃহীত হাদীসগুলোর সত্যতার ব্যাপারে ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা আজও কেউ দিতে পারবে না।
যে কোনো হাদীস সঠিক নয় বলে বিবেচিত হবে যদি তা হয়—
১. কুরআনের বক্তব্যের পরিপন্থী
২. শরীয়তের কোনো সুস্পষ্ট নীতির বিপরীত
৩. রাসূলের চরিত্র কিংবা শিক্ষার বিরূপ
৪. সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির আলোকে অথবা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বক্তব্যটি অবাস্তব
৫. সামান্য আমলে অত্যধিক ফযীলত কিংবা বেহেশতে যাওয়ার নিশ্চয়তা
৬. আমলটির প্রচলন হয় খোলাফায়ে রাশেদীনের পরবর্তী যুগে।
রাসূল (সা.) যে আমলের কথা বলেননি, হাদীসের কথা বলে তা চালু করা বা প্রচার করা নিশ্চয়ই রাসূলের নামে মিথ্যা বলার শামিল। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার নামে মিথ্যা বলবে সে অবশ্যই জাহান্নামী।’ (মুসলিম)
রাসূল (সা.) আরও বলেন, যে লোক এমন আমল করল, আমার উপস্থাপিত শরীয়ত যার অনুকূলে ও সমর্থনে নয়, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যানযোগ্য।’ (মুসলিম)
অতিরিক্ত ফযীলতের আশায় সন্দেহযুক্ত আমল করা কি বোকামি নয়? দরূদে ইবরাহীম ব্যতিত অধিকাংশ দরূদ যেমন বিদআত তেমনি বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত অনেক ধর্মীয় আমলের বইগুলোতে উদ্ধৃত অধিকাংশ আমল বিদআত বলে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ফযীলতের বর্ণনা সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি ব্যতিত মানুষের মনগড়া বলে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সকল আমল করার পূর্বে এর সূত্র যাচাই করা অত্যাবশ্যক।
৩. রাসূলের মর্যাদা ও তার প্রতি ভালোবাসা
পূর্ববর্তী সকল ধর্মগ্রন্থের বিকৃতি এবং ধর্মের মূলমন্ত্র তাওহীদ-এর জায়গায় শিরক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে— নবী-রাসূলদের ক্ষমতা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অতিরঞ্জিত কিচ্ছা-কাহিনীর প্রচলন। ফলে মানুষ স্রষ্টাকে ভুলে সৃষ্টির ইবাদতে লিপ্ত হয়।
রাসূলের ওফাতের অনেক পরে মুসলিম সমাজের কতিপয় স্বার্থান্বেষী আলেম ও ইসলামের শত্রু মানুষরূপী শয়তানেরা নানাবিধ কিচ্ছা-কাহিনী ও কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অপব্যাখ্যা এবং মানুষ রচিত কলেমা ও মিথ্যা ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে অন্যান্য নবীদের অনুসারীদের ন্যায় রাসূলের নিজস্ব অলৌকিক ক্ষমতা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের নানাবিধ কাল্পনিক চমকপ্রদ কাহিনীর প্রচলন করে। এসবের দ্বারা তারা মানুষের মনে শিরকের বীজ বপন করে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, সকল নবী-রাসূল আমাদের মতো মাটির মানুষ ছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘বলো হে নবী! আমি তোমাদের মতো মানুষ।’ (১৮:১১০, ৪১:১৬) তাদের নিজস্বে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বা মুজিজা ছিলো না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভালো-মন্দের উপরেও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতো না। আমি তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা বৈ আর কিছু নই।’ (৭:১৮৮)
এমনকি নবী-রাসূলদের মানুষকে হিদায়াত করার ক্ষমতাও ছিলো না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন, ’যাকে ভালোবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন এবং তিনিই জানেন সৎপথের অনুসারীদের।’ (২৫:৫৬)
নবী-রাসূল বলতে আল্লাহ তা‘আলা ওই সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন যাদের কাছে তিনি মানুষের জন্য জীবনবিধান নাযিল করে তা মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার ও বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব দেন। (১৬:২) এক কথায় বলা যায় যে, তারা ছিলেন আল্লাহর মনোনীত ধর্মীয় শিক্ষক।
রাসূল (সা.) বলেন, আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি যে আমার আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে তিলাওয়াত করে শোনায়, তোমাদের পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, আর তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়।’ (২:১৫১, ৩:১৬৪)
আল্লাহ আরও বলেন, ‘সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে আমি রাসূলদের এজন্য প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলদের আগমনের পর আল্লাহর সম্মুখে মানুষের কোনো ওজর আপত্তি না থাকে।’ (৪:১৬৫)
রাসূলদের কর্তব্য তো কেবল স্পষ্ট বাণী প্রচার করা; এক আল্লাহর উপাসনা করা ও মন্দকে পরিহার করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মাঝে রাসূল পাঠিয়েছি।’ (১৬:৩৫-৩৬)
রাসূলের শিক্ষা বাস্তবায়নের চেষ্ট করাই হবে রাসূলকে ভালোবাসা। আদর্শ শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র হতে হলে তাকে ভালোবাসতে হবে তার উপদেশ মেনে চলতে হবে, তার অনুশীলন করতে হবে। কথায় বলে ছাত্রের কৃতিত্বেই শিক্ষকের কৃতিত্ব। তাই রাসূলের প্রশংসায় বাড়বাড়ি না করে আমাদের উচিত কুরআন-হাদীসের অনুসরণ ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। এ শিক্ষা দেয়াটাই ছিল সকল নবী-রাসূলের একমাত্র দায়িত্ব। অথচ রাসূলকে নিয়ে রচিত নানা রকম মিথ্যা, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত কিচ্ছা-কাহিনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কুরআনের অজ্ঞ মুসলমানেরা আজ আল্লাহর চেয়ে রাসূলকে অধিক ভালোবাসতে শুরু করেছে। (২:১৬৫)
বর্তমানে মুসলিমদের অধিকাংশের আমলের ধরন থেকে দেখতে পাওয়া যায় তারা—
১. কুরআনের উপর আমল না করে রাসূলের শাফায়াত কামনা করছে। আমাদের অনেকের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রাসূলের শাফায়াত ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। (এ ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের জন্য দেখুন সূরা বাকারা, আয়াত ৪৮, ১২৩, ১৮৬)
২. আল্লাহর যিকির করা থেকে রাসূলের উপর দরূদ পাঠ উত্তম মনে করছে। (৩:১৬০, ৯:১১৬)
৩. আল্লাহর পরিবর্তে রাসূলের গুণগান গাইতে পছন্দ করছে। (২৮:৭০, ৬৪:১)
তাদের কাছে—
১. নামাযের চেয়ে মিলাদের গুরুত্ব বেশি
২. সুন্নাতের চেয়ে বিদআতি আমলের ফযীলত বেশি
৩. সর্বোপরি তাওহীদের চেয়ে শিরকের মর্যাদা বেশি।
আমল করা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘এমন কেউ নেই যার আমলই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনিও না? উত্তরে তিনি বললেন, না, আমিও না; যদি না আল্লাহর অনুগ্রহ আমার প্রতি বর্ষিত হয়।’ (মুসলিম-২৮১৬)
আর আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার শর্তগুলো আল কুরআনের মাধ্যমেই আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদেরই সুবিধার্থে মহান আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনের সব বিধি-নিষেধের সারাংশ মাত্র দশটি আয়াতের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে— সূরা তওবার একটি আয়াত (৯:১২), সূরা আহযাবের একটি আয়াত (৩৩:৩৫) এবং সূরা মুমিনুনের আটটি আয়াত (২৩:২-৯)।
সম্মানিত পাঠক, একটু ভেবে দেখুন তো, রাসূলের উম্মাতদের উপরে বর্ণিত কার্যকলাপের জন্য রাসূলকেও হয়তো ঈসা (আ.)-এর মতো আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হতে পারে (৫:১১৬-১১৮)। তাই সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।
আল্লাহ বলেন, ‘সত্য এসেছে, মিথ্যা অপসারিত হয়েছে, আর মিথ্যার পতন অবধারিত।’ (১৭:৮১)
অবশ্য সত্য জানতে হলে কুরআনের জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই। তাই জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে কুরআনের অনুবাদ অধ্যয়ন করে অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকের মতো এর আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তা থেকে উপদেশ গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি ওরা অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি ওদের অন্তর তালাবদ্ধ?’
আল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (৫৪:১৭, ২২, ৩২, ৪০)[সংকলিত]
কুরআনের জ্ঞানের অভাব এবং ভুল শিক্ষার কারণে আমাদের অধিকাংশ মুসলিম আজ কুরআনের মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে নানা প্রকার ভ্রান্ত আমলে লিপ্ত রয়েছে। এর ফল স্বরূপ আমাদের সকল আমল বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন, ‘তুমি বলে দাও, আমি কি তোমাদেরকে এমন লোকদের পরিচয় বলে দেব না, যারা আমলের দিক দিয়ে সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত! তারা ওইসব লোক, দুনিয়ার জীবনে যাদের প্রচেষ্টা বিফল হয়েছে, অথচ তারা মনে করে তারা সৎ কাজ করছে।’ (১৮:১০৩-১০৪)
আমাদের আমল ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে, ভুল শিক্ষার কারণে ৩টি মৌলিক বিষয় সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা। তা হচ্ছে—
১. কুরআনের মূল্যায়নে ব্যর্থতা,
২. হাদীসের গুরুত্ব,
৩. রাসূল (সা.)-এর মর্যাদা ও তাঁর প্রতি ভালোবাসা।
১. কুরআনের মূল্যায়নে ব্যর্থতা
কুরআন হচ্ছে ইসলামের মূল পাঠ্যপুস্তক বা টেক্সট বই। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, এ কুরআন ‘মানুষের জন্য হিদায়াত, সৎপথের স্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্যাসত্যের পার্থক্যকারী।’ (সূরা বাকারা: ১৮৫)
‘এ কুরআন এক বরকতময় কিতাব যা আমি তোমার (রাসূল) প্রতি নাযিল করেছি, যাতে মানুষেরা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে ও বোধশক্তি সম্পন্ন ব্যক্তিরা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (৩৮:২৯)
‘এ কুরআন মানুষের জন্য সুস্পষ্ট দলিল এবং দৃঢ় বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য হিদায়াত ও রহমত।’ (৪৫:২০)
‘এ কুরআন সমগ্র জগতের জন্য উপদেশ ব্যতীত কিছুই নয়।’ (৬৮:৫২)
অথচ কুরআনের উপদেশ গ্রহণের আগ্রহ আমাদের মধ্যে নেই। যেহেতু আমাদের অধিকাংশের ধারণা সহীহ উচ্চারণে (যা চালু হয় রাসূলের পরের যুগে) অর্থ ও মর্ম না বুঝে কুরআন তিলাওয়াত হচ্ছে কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্য। আর ইবাদতের জন্য হাদীসের অনুসরণ ও বাস্তবায়ন যথেষ্ট।
আসলে কুরআনের বিধি বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করাটাই হচ্ছে কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্য। কেবল অর্থ বুঝে কুরআন তিলাওয়াত করলে অর্থাৎ পড়লে এবং সে অনুযায়ী আমল করলে আল্লাহর রহমত অর্জন সম্ভব। না বুঝে পড়া সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘কুরআন নাযিলের উদ্দেশ্যই হলো বুঝে পড়া।’ (বুখারী ও মুসলিম)
কুরআন বুঝে পড়তে হলে সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াতে প্রদত্ত দিকনির্দেশনার অনুসরণ করতে হবে। অর্থাৎ মুহকাম (সুস্পষ্ট) এবং মুতাশাবিহ (রূপক) আয়াতের গুরুত্ব অনুধাবন এবং তার সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, কুরআন হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার প্রণয়নকৃত ও নাযিলকৃত আমাদের জীবনবিধান। এ বিধান অনুযায়ী জীবন গড়া বা না গড়া ও তার পরিণাম সম্পর্কিত বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে কুরআনে ব্যক্ত করা হয়েছে, যার অতিরিক্ত কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয় না। কেননা এগুলোই হচ্ছে মুহকাম আয়াত। তাছাড়া কুরআনে বিভিন্ন নবীর জীবনী, তাদের দায়িত্ব, আল্লাহ প্রদত্ত মুজিজা ও মর্যাদা এবং কওমের উত্থান-পতনের ঘটনা নানাভাবে বার বার বর্ণনা করা হয়েছে, যাতে মানুষ তা থেকে উপদেশ গ্রহণ করে (১৭:৪৯)। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এ সকল আয়াতের ব্যাখ্যা সম্ভব। তাই সূরা আলে ইমরানের ৭নং আয়াতে এ সকল আয়াতের মনগড়া ব্যাখ্যা পরিহারের কথা বলা হয়েছে।
সুধী পাঠক, আল কুরআন না বুঝে পড়ার ফলেই মুসলমানরা আজ প্রকৃত সত্য এবং প্রকৃত শিক্ষা থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। অথচ কুরআন বুঝে তা বাস্তবে প্রয়োগের ফলেই আল্লাহ তা‘আলা স্বর্ণযুগের মুসলমানদের দিয়েছিলেন পৃথিবীর কর্তৃত্ব। এই কর্তৃত্ব প্রদান সর্ব যুগের জন্য প্রযোজ্য। (দেখুন আল কুরআন ২৪:৫৫)
কুরআন বুঝতে হলে যে কোনো পাঠ্যপুস্তকের মতই তা নিজ ভাষায় বুঝে অধ্যয়ন করতে হবে। নিজ ভাষায় অধ্যয়ন করলে এর উপদেশবাণী হাদীস ও তাফসীরের সাহায্য ছাড়াই অনুধাবন সম্ভব। কুরআন বুঝা শুধু ধর্মীয় আলেম ও ইমাম সাহেবদের কর্তব্য নয়। এর বিধি বিধান জানা ও মানা সকল মুসলমানের জন্য ফরয। তাই আল্লাহ তা‘আলা কুরআন বুঝা সহজ করে দিয়েছেন।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, ‘আমি তো তোমার ভাষায় কুরআন সহজ করে দিয়েছি যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে।’ (৪৪:৫৮)
কুরআন আরবীতে নাযিল হওয়ার একমাত্র কারণ, এটা ছিল রাসূলের মাতৃভাষা। আল্লাহ বলেন, ‘আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার নিজ জাতির ভাষা-ভাষী করে পাঠিয়েছি, তাদের জাতির কাছে পরিষ্কার করে ব্যাখ্যা করার জন্য। (১৪:৪, ৪১:৪৪) এখানে উল্লেখ্য যে, রাসূল (সা.) নিজেও অনুবাদকের মাধ্যমে অন্যান্য ভাষা-ভাষীদের কাছে তাদেরই মাতৃভাষায় কুরআনের বাণী পৌঁছিয়েছেন।
সুধী পাঠক, একটু ভেবে দেখুন, কুরআন আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশি পঠিত কিতাব। প্রতিনিয়ত কুরআন তিলাওয়াত ছাড়াও আমরা প্রতিদিন কুরআনের আয়াতের সাহায্যে নামায আদায় করি, দু‘আ করি। বিপদে-আপদে, অসুখে-বিসুখে এবং অন্যান্য প্রয়োজনে কুরআনের আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত কামনা করি। অথচ দুঃখের বিষয় হলেও এটা কি সত্যি নয় যে, আমাদের অধিকাংশ যা পড়ছে বা তিলাওয়াত করছে, তার কিছুই তারা বুঝে না?
কুরআনের জ্ঞান আপনার ধর্মীয় চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আমূল পরিবর্তন এনে দিবে, যা আপনার ঈমান ও তাকওয়া বৃদ্ধি এবং হাদীসের বক্তব্যের সঠিকতা নির্ণয়ে সহায়ক হবে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, কুরআনের জ্ঞান অর্জন করা এবং নিজেদের প্রিয়জনকে এ উপদেশ দেয়া আমাদের ঈমানী দায়িত্ব। আল্লাহ বলেন, ‘যারা জ্ঞান রাখে আর যারা রাখে না, তারা কি কখনো সমান হতে পারে? (৩৯:৯)
রাসূল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি সে, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অপরকে শিক্ষা দেয়।’ (বুখারী ও মুসলিম)
কুরআনের মৌলিক শিক্ষা
১. এক আল্লাহর একত্ব, সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিতে হবে। (১:৪, ৯৮:৫)
২. নবী-রাসূল ও সকল মানুষই আল্লাহর সৃষ্টি ও আল্লাহর দাস, সুতরাং মানুষের মনগড়া আইন নয় বরং আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান মেনে জীবন পরিচালনা করতে হবে। (২৮:৭০, ৮৮, ৫:৭২)
৩. কুরআন ও সহীহ হাদীস বহির্ভূত আমল পরিত্যাগ করতে হবে।
৪. সকল কাজ ও ইবাদতে নবীর অনুকরণ ও অনুসরণ করতে হবে। (৪:৮০)
২. হাদীসের গুরুত্ব
হাদীস হচ্ছে মূলত আল্লাহ প্রদত্ত কুরআনের ব্যাখ্যা গ্রন্থ বা নোট বই এবং সুন্নাত ও নফল (অতিরিক্ত) আমলের সূত্র।
আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেন, ‘ওরা তোমার নিকট কোনো সমস্যা নিয়ে এলে আমি তোমাকে তার সঠিক সমাধান ও সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়ে থাকি।’ (২৫:৩৩) ‘তার বিশদ ব্যাখ্যা করে দেয়ার দায়িত্বও আমার।’ (৭৫:১৯)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘সে (রাসূল) নিজের ইচ্ছামত কোনো কথা বলে না (ধর্মীয় বক্তব্য দেয় না), সে যা বলে সবই আল্লাহর ওহী।’ (৫৩:৩-৪)
রাসূল (সা.) বলেন, ‘আমার নিকট ওহীর মাধ্যমে যা নাযিল হয়, আমি শুধু তারই অনুসরণ করি।’ (৬:৫০, ৭:২০৩, ১০:১৫ এবং ৪৬:৯)
উপরিউক্তি আয়াতগুলো পর্যালোচনা করে এটা সহজেই বলা যায় যে, হাদীসের সকল বক্তব্য আল্লাহর বাণী যা রাসূল (সা.) নিজ ভাষায় ব্যক্ত করেতেন। সুতরাং কুরআন হাদীস বহির্ভূত বক্তব্য বা আমল ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। বরং তা বিদআত। মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য শয়তানের অপচেষ্টা। এ সত্য উপলব্ধি করলে সহজেই শিরক ও বিদআতমুক্ত আমল করা সম্ভব।
হাদীস গ্রন্থগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাবো যে, রাসূল (সা.) কেবল কুরআনের ব্যাখ্যাই দেননি। তিনি যেভাবে কুরআন বাস্তবায়ন করেন তার বিস্তারিত বিবরণও এর অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া তিনি তার সাহাবীদের বিভিন্ন সময়ে নফল আমল ও তার ফযীলতের কথাও জানিয়েছেন। অবশ্য রাসূল (সা.) বুঝতে পেরেছিলেন যে, নও মুসলিমরা কুরআনের জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে সেসব ফযীলতের আমলকে প্রাধান্য দেবে। তাই তিনি তার জীবদ্দশায় কুরআনের শিক্ষা বিস্তারের পূর্বে এ সকল আমলের কথা লিখতে এবং জনসাধারণের কাছে তার প্রচার নিষেধ করেছেন।
রাসূলের এ নিষেধবাণী উপেক্ষা করে, কুরআনের জ্ঞান অর্জনের পরিবর্তে কেবল হাদীসের অনুসরণের ফলে মুসলিমরা আজ পথভ্রষ্ট ও ভ্রান্ত আমলে লিপ্ত।
অল্প চেষ্টায় অধিক লাভের আশা করা মানুষের চারিত্রিক দুর্বলতা। রাসূলের পরবর্তী যুগে মানুষের এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইসলামের শত্রু কতিপয় মিথ্যুক হাদীস বর্ণনাকারী ও স্বার্থপর আলেমরা সাহাবীদের উদ্ধৃতি দিয়ে লক্ষ লক্ষ জাল হাদীসের প্রচলন ও প্রচার আরম্ভ করে। মুসলমানেরা এই সকল হাদীসের অনুসরণ করে বিপথগামী হতে থাকে।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেই কুরআন হিফাযতের ঘোষণা দেন। আল্লাহ বলেন, ‘আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।’ (১৫:৯) দুর্ভাগ্যবশতঃ হাদীস সংরক্ষণে সর্বাত্মক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও পূর্ববর্তী ধর্মগ্রন্থগুলোর ন্যায় হাদীসশাস্ত্রেও নানা প্রকার বিকৃতির অনুপ্রবেশ ঘটে। হাদীস বিশারদদের দ্বারা স্বীকৃত ১নং সহীহ হাদীস গ্রন্থের সংকলনকারী ইমাম বুখারী (রহ.) ১০ (দশ) লক্ষের অধিক হাদীস সংগ্রহ করে নির্ভরযোগ্যতার ১৮টি পন্থায় যাচাই-বাছাই করে সর্বমোট মাত্র ৭,৩৯৭টি হাদীস সহীহ বুখারী শরীফের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তা ছিলো ১%-এর কম, বাকি ৯৯ শতাংশের বেশি মিথ্যা বা সঠিক নয় বলে পরিত্যাগ করেন। অবশ্য সহীহ বলে গৃহীত হাদীসগুলোর সত্যতার ব্যাপারে ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা আজও কেউ দিতে পারবে না।
যে কোনো হাদীস সঠিক নয় বলে বিবেচিত হবে যদি তা হয়—
১. কুরআনের বক্তব্যের পরিপন্থী
২. শরীয়তের কোনো সুস্পষ্ট নীতির বিপরীত
৩. রাসূলের চরিত্র কিংবা শিক্ষার বিরূপ
৪. সাধারণ জ্ঞান-বুদ্ধির আলোকে অথবা বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বক্তব্যটি অবাস্তব
৫. সামান্য আমলে অত্যধিক ফযীলত কিংবা বেহেশতে যাওয়ার নিশ্চয়তা
৬. আমলটির প্রচলন হয় খোলাফায়ে রাশেদীনের পরবর্তী যুগে।
রাসূল (সা.) যে আমলের কথা বলেননি, হাদীসের কথা বলে তা চালু করা বা প্রচার করা নিশ্চয়ই রাসূলের নামে মিথ্যা বলার শামিল। রাসূল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত আমার নামে মিথ্যা বলবে সে অবশ্যই জাহান্নামী।’ (মুসলিম)
রাসূল (সা.) আরও বলেন, যে লোক এমন আমল করল, আমার উপস্থাপিত শরীয়ত যার অনুকূলে ও সমর্থনে নয়, তা অবশ্যই প্রত্যাখ্যানযোগ্য।’ (মুসলিম)
অতিরিক্ত ফযীলতের আশায় সন্দেহযুক্ত আমল করা কি বোকামি নয়? দরূদে ইবরাহীম ব্যতিত অধিকাংশ দরূদ যেমন বিদআত তেমনি বাংলাদেশের বাজারে প্রচলিত অনেক ধর্মীয় আমলের বইগুলোতে উদ্ধৃত অধিকাংশ আমল বিদআত বলে প্রতীয়মান হয়। বিশেষ করে কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ফযীলতের বর্ণনা সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি ব্যতিত মানুষের মনগড়া বলে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সকল আমল করার পূর্বে এর সূত্র যাচাই করা অত্যাবশ্যক।
৩. রাসূলের মর্যাদা ও তার প্রতি ভালোবাসা
পূর্ববর্তী সকল ধর্মগ্রন্থের বিকৃতি এবং ধর্মের মূলমন্ত্র তাওহীদ-এর জায়গায় শিরক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে— নবী-রাসূলদের ক্ষমতা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে অতিরঞ্জিত কিচ্ছা-কাহিনীর প্রচলন। ফলে মানুষ স্রষ্টাকে ভুলে সৃষ্টির ইবাদতে লিপ্ত হয়।
রাসূলের ওফাতের অনেক পরে মুসলিম সমাজের কতিপয় স্বার্থান্বেষী আলেম ও ইসলামের শত্রু মানুষরূপী শয়তানেরা নানাবিধ কিচ্ছা-কাহিনী ও কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের অপব্যাখ্যা এবং মানুষ রচিত কলেমা ও মিথ্যা ঘটনার বর্ণনার মাধ্যমে অন্যান্য নবীদের অনুসারীদের ন্যায় রাসূলের নিজস্ব অলৌকিক ক্ষমতা, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের নানাবিধ কাল্পনিক চমকপ্রদ কাহিনীর প্রচলন করে। এসবের দ্বারা তারা মানুষের মনে শিরকের বীজ বপন করে।
আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, সকল নবী-রাসূল আমাদের মতো মাটির মানুষ ছিলেন। আল্লাহ বলেন, ‘বলো হে নবী! আমি তোমাদের মতো মানুষ।’ (১৮:১১০, ৪১:১৬) তাদের নিজস্বে কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বা মুজিজা ছিলো না। রাসূল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া আমার নিজের ভালো-মন্দের উপরেও আমার কোনো অধিকার নেই। আমি যদি অদৃশ্যের খবর জানতাম তবে তো আমি প্রভূত কল্যাণই লাভ করতাম এবং কোনো অকল্যাণই আমাকে স্পর্শ করতো না। আমি তো শুধু মুমিন সম্প্রদায়ের জন্য সতর্ককারী ও সুসংবাদদাতা বৈ আর কিছু নই।’ (৭:১৮৮)
এমনকি নবী-রাসূলদের মানুষকে হিদায়াত করার ক্ষমতাও ছিলো না। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর রাসূলকে বলেন, ’যাকে ভালোবাস, ইচ্ছা করলেই তাকে সৎপথে আনতে পারবে না। তবে আল্লাহই যাকে ইচ্ছা সৎপথে আনেন এবং তিনিই জানেন সৎপথের অনুসারীদের।’ (২৫:৫৬)
নবী-রাসূল বলতে আল্লাহ তা‘আলা ওই সকল ব্যক্তিকে বুঝিয়েছেন যাদের কাছে তিনি মানুষের জন্য জীবনবিধান নাযিল করে তা মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেবার ও বুঝিয়ে দেবার দায়িত্ব দেন। (১৬:২) এক কথায় বলা যায় যে, তারা ছিলেন আল্লাহর মনোনীত ধর্মীয় শিক্ষক।
রাসূল (সা.) বলেন, আমি শিক্ষকরূপে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের কাছে রাসূল প্রেরণ করেছি যে আমার আয়াতসমূহ তোমাদের কাছে তিলাওয়াত করে শোনায়, তোমাদের পবিত্র করে এবং কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেয়, আর তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়।’ (২:১৫১, ৩:১৬৪)
আল্লাহ আরও বলেন, ‘সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে আমি রাসূলদের এজন্য প্রেরণ করেছি যাতে রাসূলদের আগমনের পর আল্লাহর সম্মুখে মানুষের কোনো ওজর আপত্তি না থাকে।’ (৪:১৬৫)
রাসূলদের কর্তব্য তো কেবল স্পষ্ট বাণী প্রচার করা; এক আল্লাহর উপাসনা করা ও মন্দকে পরিহার করার নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তো প্রত্যেক জাতির মাঝে রাসূল পাঠিয়েছি।’ (১৬:৩৫-৩৬)
রাসূলের শিক্ষা বাস্তবায়নের চেষ্ট করাই হবে রাসূলকে ভালোবাসা। আদর্শ শিক্ষকের প্রিয় ছাত্র হতে হলে তাকে ভালোবাসতে হবে তার উপদেশ মেনে চলতে হবে, তার অনুশীলন করতে হবে। কথায় বলে ছাত্রের কৃতিত্বেই শিক্ষকের কৃতিত্ব। তাই রাসূলের প্রশংসায় বাড়বাড়ি না করে আমাদের উচিত কুরআন-হাদীসের অনুসরণ ও বাস্তবায়নের চেষ্টা করা। এ শিক্ষা দেয়াটাই ছিল সকল নবী-রাসূলের একমাত্র দায়িত্ব। অথচ রাসূলকে নিয়ে রচিত নানা রকম মিথ্যা, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত কিচ্ছা-কাহিনীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কুরআনের অজ্ঞ মুসলমানেরা আজ আল্লাহর চেয়ে রাসূলকে অধিক ভালোবাসতে শুরু করেছে। (২:১৬৫)
বর্তমানে মুসলিমদের অধিকাংশের আমলের ধরন থেকে দেখতে পাওয়া যায় তারা—
১. কুরআনের উপর আমল না করে রাসূলের শাফায়াত কামনা করছে। আমাদের অনেকের ভ্রান্ত ধারণা এই যে, রাসূলের শাফায়াত ছাড়া কেউ বেহেশতে যেতে পারবে না। (এ ভ্রান্ত ধারণা নিরসনের জন্য দেখুন সূরা বাকারা, আয়াত ৪৮, ১২৩, ১৮৬)
২. আল্লাহর যিকির করা থেকে রাসূলের উপর দরূদ পাঠ উত্তম মনে করছে। (৩:১৬০, ৯:১১৬)
৩. আল্লাহর পরিবর্তে রাসূলের গুণগান গাইতে পছন্দ করছে। (২৮:৭০, ৬৪:১)
তাদের কাছে—
১. নামাযের চেয়ে মিলাদের গুরুত্ব বেশি
২. সুন্নাতের চেয়ে বিদআতি আমলের ফযীলত বেশি
৩. সর্বোপরি তাওহীদের চেয়ে শিরকের মর্যাদা বেশি।
আমল করা সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেন, ‘এমন কেউ নেই যার আমলই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে। সাহাবাগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আপনিও না? উত্তরে তিনি বললেন, না, আমিও না; যদি না আল্লাহর অনুগ্রহ আমার প্রতি বর্ষিত হয়।’ (মুসলিম-২৮১৬)
আর আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়ার শর্তগুলো আল কুরআনের মাধ্যমেই আমাদেরকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদেরই সুবিধার্থে মহান আল্লাহ তা‘আলা আল কুরআনের সব বিধি-নিষেধের সারাংশ মাত্র দশটি আয়াতের মাধ্যমে ব্যক্ত করেছেন। সেগুলো হচ্ছে— সূরা তওবার একটি আয়াত (৯:১২), সূরা আহযাবের একটি আয়াত (৩৩:৩৫) এবং সূরা মুমিনুনের আটটি আয়াত (২৩:২-৯)।
সম্মানিত পাঠক, একটু ভেবে দেখুন তো, রাসূলের উম্মাতদের উপরে বর্ণিত কার্যকলাপের জন্য রাসূলকেও হয়তো ঈসা (আ.)-এর মতো আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হতে পারে (৫:১১৬-১১৮)। তাই সত্য উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন।
আল্লাহ বলেন, ‘সত্য এসেছে, মিথ্যা অপসারিত হয়েছে, আর মিথ্যার পতন অবধারিত।’ (১৭:৮১)
অবশ্য সত্য জানতে হলে কুরআনের জ্ঞান অর্জনের বিকল্প নেই। তাই জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্যে কুরআনের অনুবাদ অধ্যয়ন করে অন্যান্য পাঠ্যপুস্তকের মতো এর আয়াতগুলো নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করে তা থেকে উপদেশ গ্রহণে সচেষ্ট হতে হবে।
আল্লাহ বলেন, ‘তবে কি ওরা অভিনিবেশ সহকারে চিন্তা-ভাবনা করে না? নাকি ওদের অন্তর তালাবদ্ধ?’
আল্লাহ আরও বলেন, ‘আমি কুরআনকে সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য, অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছে কি? (৫৪:১৭, ২২, ৩২, ৪০)[সংকলিত]
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!