বায়তুল মোকাদ্দাস বা মসজিদে আকসা আমাদের প্রথম কেবলা। এখন আর তা আমাদের হাতে নেই। যে মসজিদে আকসা দিনে পাঁচবার আজানের আওয়াজে গুঞ্জরিত হতো আটশ বছর পর সেখানে আজান বন্ধ হয়ে গেছে। মসজিদে আকসা আজ অভিশপ্ত ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে। কমপক্ষে এক লাখ নবী-রাসূলের স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিন আজ ওই অভিশপ্ত সম্প্রদায়ের শিকারে পরিণত হয়েছে যাদের অভিধানে নিরাপত্তা, ইনসাফ, নৈতিকতা, ভদ্রতার কোনো নাম-গন্ধও নেই। সীনা উপত্যকা যাকে কোনোকালে ইহুদি সম্প্রদায়ের জন্য ‘ময়দানে তীহ’ বানানো হয়েছিল সেখানে আজ ইসরাইল ট্যাঙ্ক সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। তুর পর্বত যা আল্লাহর নূরের তাজাল্লি লাভে সৌভাগ্যবান, যার আস্তিনে ইহুদিদের ওপর আল্লাহর আজাব বিচ্ছুরণ লুকায়িত ছিল-আজ সেই তুর পর্বতে ইহুদি তারকার দীপ্তি ছড়িয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া ও বায়তুল মোকাদ্দাসের ওই ভূখণ্ড যাকে কুরআনে কারিম সবসময় ‘আরদে মোবারক’ এবং ‘আরদে মুকাদ্দাসা’ বলে অভিহিত করা হয়েছে-সেই পবিত্র ভূমি ঈমানদারদের খুনে প্রবাহিত হচ্ছে। তাদের বর্বরতা আজ অতীতের সমস্ত রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মুসলমানদের রক্ত নিয়ে আজ তারা তামাশা খেলছে।
ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ঘরবাড়ি ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাদের সম্ভ্রম লুটে নিচ্ছে। মানবতা আজ সেখানে ভূলুণ্ঠিত। নিঃসন্দেহে তা মুসলিম বিশ্বের জন্য একটি বড় ট্রাজেডি। এতে আজ প্রতিটি মুসলমানের অন্তরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।
শব্দের পরিবর্তনের দ্বারা বাস্তবতার পরিবর্তন হয় না। আমাদের খোলামেলা স্বীকার করা উচিত যে, এটা আমাদের মুসলিম জাতিসত্তার বড় পরাজয়। এটা এমন এক পরাজয় যার কোনো নজির ইসলামি ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। আরব দেশসমূহের অপার শক্তি ও সম্ভাবনা আজ এর কোনোটিই কাজে লাগছে না। মাত্র আট হাজার বর্গমাইলের একটি ছোট্ট রাষ্ট্র ২৪ হাজার বর্গমাইলের রাষ্ট্রকে দখল করে নিল। আটশ বছর পর বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত হয়ে যাওয়াটা এমন কোনো সামান্য আঘাত নয় যা সহজেই ভোলার মতো। এটা এমন এক আঘাত যাতে রক্তক্ষরণ হতে থাকবে অনবরত। যতক্ষণ না কোনো সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর জন্ম না হবে ততক্ষণ তা চলতে থাকবে।
এই পৃথিবীতে কোনো ঘটনাই কোনো কারণ ছাড়া সংঘটিত হয় না। প্রত্যেক ঘটনার পেছনে বাহ্যিক কিছু কারণ ও ক্রিয়ার ধারাক্রম থাকে। এমনিভাবে আমাদের বিশ্বাস হলো, পৃথিবীর প্রতিটি ঘটনাই শিক্ষা ও নসিহতের এক বিশাল বহর নিয়ে আসে। প্রত্যেক ট্রাজেডিই আসে জাগ্রতকরণের জন্য। জীবনের বন্ধুর পথে ওই জাতিই উন্নতির ধাপসমূহ অতিক্রম করতে পারে যারা প্রতিবন্ধকতার স্থানগুলো চিহ্নিত করে তা উৎরে যাওয়ার কৌশল খোঁজে। এজন্য এই বিপর্যয়ে শুধু হা-হুতাশ করাই আমাদের দায়িত্ব নয়। বরং ইতিহাসের এই করুণ ট্রাজেডি আমাদেরকে সতত ভাবিত করে। আমরা এই দুনিয়াতে বসবাস করতে হলে এ ঘটনার চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে হবে। ফিলিস্তিন ট্রাজেডি নিঃসন্দেহে মুসলমানদের জীবনের একটি করুণ অধ্যায়। অপদস্ত ও বিপর্যয়ের এক খোলা দলিল। তবে আমরা যদি এ ঘটনা থেকে ভালো কোনো শিক্ষা নিতে পারি তাহলে হয়ত আমাদের এই বিপর্যয় বিজয়ে পর্যবসিত হতে পারে। অশ্রু বিসর্জন দিয়ে হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। স্পৃহা ও চৈতন্য জাগ্রতকরণের এটাই সুবর্ণ সুযোগ। এখন সময় হলো নিজেদের বিচ্ছুতি ও অসংলগ্নতা পর্যালোচনা করার।
সহমর্মিতা ও সমবেদনার দাবি হচ্ছে, এই দুর্যোগময় মুহূর্তে আমাদের আরব ভাইদের এই বিচ্যুতির প্রতি খোলামেলা ইঙ্গিত না করা। এমন কোনো ভুল ধরিয়ে না দেয়া যাতে ঘটনার দায়ভার পুরোটাই তাদের কাঁধে চেপে বসে। কিন্তু আমাদের কাছে এ পদ্ধতির চেয়ে উপকারী কোনো পদ্ধতি নেই এবং তা প্রকৃত সমবেদনা জ্ঞাপনও হবে না যতক্ষণ না ঘটনার জন্য দায়ী প্রকৃত ভুলগুলো চিহ্নিত করা হবে। এজন্য সামনের কিছু বক্তব্যের জন্য আমি আমার আরব ভাইদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি। যেহেতু এসব তিক্ত বিষয়ের অবতারণা মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা ছাড়া আর কিছু নয় এজন্য আমি আশাবাদী সবাই বিষয়টিকে ঠান্ডা মাথায়, সহিঞ্চুতার সঙ্গে গ্রহণ করবেন।
কুরআন-সুন্নাহ এবং জাতিসমূহের উত্থান-পতনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথা অতি স্পষ্ট হযে যায় যে, কোনো জাতি বা সম্প্রদায়ের পার্থিব উন্নতি শুধু এজন্যই নসিব হয় না যে, তারা আসমান থেকেই উৎকর্ষ ও সৌভাগ্যের অধিকার নিয়ে দুনিয়াতে এসেছে। আল্লাহর নেজাম শুরু থেকেই এ রকম চলে আসছে, দুনিয়াতে চেষ্টা-সাধনার ভিত্তিতেই প্রত্যেককে তাদের কাঙ্ক্ষিত অংশ দেয়া হয়। মুসলমানরাও কুদরতের অমোঘ এই ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নয়। নিঃসন্দেহে তাদের ‘শ্রেষ্ঠ জাতির’ মর্যাদায় ভূষিত করা হয়েছে।
এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, মুসলিম জাতি আল্লাহর কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এটাও সর্বজন স্বীকৃত, দুনিয়ার বুকে কোনো ধর্ম মুসলমানদের ধর্মের সমকক্ষ নেই। কিন্তু এসবের দ্বারা কখনও এই ফলাফল বের হয় না যে, কোনো জাতি শুধু মৌখিকভাবে নিজেদের মুসলমান হওয়ার দাবি করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলেই আকাশ স্পর্শ করতে পারবে। হাতের ওপর হাত রেখে বসে থাকলেও সাফল্য ও কামিয়াবির দায়িত্ব হলো তাদের কাছে এসে পদচুম্বন করা। কুরআনে কারিম ও ইসলামি ইতিহাসের মোটামুটি পর্যালোচনা দ্বারা এ কথা প্রমাণ করা যথেষ্ট যে, মুসলমানদের শির উঁচু করার জন্য যাবতীয় ওয়াদা দুটি শর্তের ভিত্তিতে- ১. সঠিক অর্থে মুসলমান হয়ে নিজের জীবনকে প্রত্যেক স্তরে ইসলামের অনুসারী বানিয়ে নেয়া। ২. উন্নতির বাহ্যিক উপকরণ ও মাধ্যমসমূহ জমা করা।
উল্লিখিত দুটি জিনিস এমন যার ওপর আমাদের উন্নতি ও সাফল্যের ভেদ লুকায়িত। কুরআনে কারিমেও তা অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। একদিকে বলা হয়েছে, ‘তোমরাই বিজয়ী হবে, যদি তোমরা মুমিন হও।’ অন্যদিকে বলা হয়েছে, ‘আর তোমরা ওই দুশমনের মোকাবেলায় ওই শক্তি এবং ঘোড়ার ছাউনি তৈরি কর যা তোমাদের সামর্থ্যে কূলায়। আর যা দ্বারা তোমরা আল্লাহর শত্রু এবং তোমাদের শত্রুদের ভয় দেখাবে।
ইসলামের ইতিহাসে যে বিপ্লবের দিকেই আপনি নজর দেবেন, কুরআনে কারিমের এই ঘোষণার সত্যতা স্পষ্ট হয়ে যাবে। যেখানে মুসলমানরা সাচ্চায় মুসলমান হয়ে বাহ্যিক উপকরণ ও মাধ্যম জমা করে সাধ্যমতো সাধনা করেছে, সেই প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দুশমনদের মোকাবেলায় যত কমই হোক না কেন তারা সব সময় বিজয়ের মালা তাদেরই আনুকূল্যে রয়েছে। পরাজয়ের গ্লানি শুধু মুসলমানদের ওই সময় ওঠাতে হয়েছে যখন তারা উল্লিখিত দুটি আহকামের কোনো একটি থেকে মুখ ফিরিয়ে বসে রয়েছে।
[জহির উদ্দিন বাবর অনূদিত ‘আধুনিক যুগে ইসলাম’ গ্রন্থ থেকে নেয়া]
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!