সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ
দেওবন্দের সমকালিন সব আলেম এব্যাপারে একমত, যে একসময়ের ডাকাত সরদার, পরবর্তি মুবাল্লীগে ইসলাম হযরত মিয়াজি মুসা রহ. "মুস্তাজাবুদ দাওয়াত" ছিলেন।
এই মহান দাঈ'র কাছে দোয়া চাইতেন বড় বড় শায়খুল মাশায়েখগন। পরবর্তিতে লাখ লাখ মিয়াজি মুসা তৈরি হলেও আমাদের আকাবিরদের যুগে এবং মেহনতের প্রথম যামনায় তাবলীগের পরশে ডাকাত সর্দার মুসার পরিবর্তন ছিল সমকালিন যুগে আলোচিত বিষয়। হযরত মিয়াজি মুসা (রহমতুল্লাহ আলাইহি) সম্পর্কে আমি পূর্বেও বহু লিখেছি। আমাদের আকাবিরদের লেখা 'আপবীতি' সাওহানাতে ইউসুফ, তাজকিরায়ে খলিল সহ বহু কিতাবে তাঁর কথা ও ঘটনাবলী স্থান পেয়েছে।
একদিন মিয়াজী মুসাকে সাথে করে দারুল উলুম দেওবন্দ নিয়ে গেলেন মুফতি কেফায়তুল্লাহ রহ.। মিয়াজী উলামাদের সামনে বসতেন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে। তার সামনে বা মঞ্চে কোন আলেম থাকলে তিনি কথা বলতেন না তাজিম করে। উলামাদের প্রতি মিয়াজী মুসার ভক্তি ছিল চেখে পড়ার মতো এক আদর্শ। আর এই মুসাকে দেওবন্দ নিয়ে গিয়ে মুফতি আজম কেফায়তুল্লাহ, হাকীমুল ইসলাম ক্বারী তাইয়্যাব রহ.সহ বড় বড় বুর্জুগানে কেরাম পুরো দারুল উলুমের আসাতিজায়ে কেরাম ও ত্বালেবে এলেমদের একত্র করলেন। সেখানে দেওবন্দের বড় বড় উস্তাদ শায়েখগন তাকে জোর অনুরোধ করলেন, দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র শিক্ষকদের উদ্দ্যেশে কিছু নসিহত করতে। মিয়াজী মুসা কাঁদতে থাকলেন। অনেক্ষন পর কাঁদা বন্ধ করে বললেন, "এটাই তাবলীগ"...
এই যে আমি জাহেল গণ্ডমূর্খ ডাকাত মুসা দারুল উলুম দেওবন্দের মিম্বারে বসে আছি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলেমদের সামনে কথা বলছি। যদিও কথা বলতে বাধ্য করা হয়েছে আমাকে। এই একটি মাত্র কথাই "এটাই তাবলীগ" সবার মাঝে ব্যাপক প্রভাব তৈরি করেছিল।
পরে সকলের পিড়াপিড়িতে তিনি আরো কিছু কথা বললেন। তার নিজের জীবনের কথা বলে সেই বিখ্যাত ঘটনা বললেন, যা শুনে দারুল উলুম দেওবন্দের বড় বড় শায়েখ আর ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। এই সুপ্রসিদ্ধ ঘটনাটি মিয়াজী মুসার জবান থেকেই প্রথম বের হয়েছিল দেওবন্দের মিম্বারে বসে।
সেই ঘটনা হল...
মিয়াজী মুসা বললেন, "বাবার দুই ছেলে। একজন বড় সমজদার, কর্মট, বিচক্ষন, প্রজ্ঞাবান, জ্ঞানী, কামোদ্দ্যমি। যিনি যর্থাথই বাবার যোগ্য উত্তরসুরী। সত্যকারের ওয়ারেস। আরেকজন ছোট, অবুজ, অযোগ্য। বাবা একদিন দুই পুত্রকে কাছে ডাকলেন, বললেন, "আমার কাছে হিরক খন্ডের ন্যায় অনেক দামী ভারী ওজনদার একটা কি'মতি জিনিস আছে। এটা অমুক নিদৃষ্ট স্থানে পৌছে দিতে হবে।"
বাবার ইচ্ছে বড় ছেলেই এই দামী জিনিসটি সঠিক রক্ষনাবেক্ষনের মাধ্যমে আমানতের সাথে দ্রুত পৌছে দেয়ার একমাত্র যোগ্যতা বহন করে এবং সে এর যর্থাথ হকদার। বাবার দৃষ্টি বড় ছেলের প্রতি!
তখন বড় ছেলে বলল, "আব্বাজী আমি আপনার অবর্তমানে এখন আপনার সমস্ত জিনিস দেখাশুনা করি। আপনার মেইল ফ্যাক্টরি পরিচালনা করি। আপনার ব্যাবসা বানিজ্য চালাই। সংসারের জাবতীয় কাজ, বাজার-হাট আমিই করি। আপনার এতো সব বড় বড় কাজ সঠিক ভাবে আন্জাম দেয়ার পর আমি কি ভাবে আবার এই জিনিস পৌছে দিব? আমার সেই সময় কোথায়? বাস্তবিকই আমি আপনার আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ নিয়ে মহাব্যস্থ, এই জিনসের দ্বায়িত্ব নিলে আপনার অন্যদিকের অনেক বড় বড় কাজের ক্ষতি হয়ে যাবে। আপনিই তো দেখছেন আমার হাতে এক মুহুর্তের সময় নেই"।
তাই ছোট ছেলে তখন বাবার করুন চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে না বুঝেই সেই কিমতি জিনসকে মন্জিলে মকসুদে পৌছে দিতে তৈরি হল। কারন বাবার এই কিমতি জিনিস পৌছে দিতেই হবে এটা বাবার নির্দেশ, বাবার শেষ ইচ্ছে, বাবার মহা আমানত। এটাকে এড়িয়ে যাবার বা অবহেলা করার কোন সুযোগ নেই।
ছোট ভাই তখন সেই ভার কাঁধে নেয়। চলতে থাকে। কখনো সামনে কঠিন পথ দেখলে ভয়ে থমকে যায়। সাহস হারিয়ে জড়োসড়ো হয়ে যায়। কখনো অপরিচিত গন্তব্য পথে, পথ হারিয়ে ফেলে। কখনো পিচ্ছিল পথে কিমতি জিনিসকে হুচট খেয়ে কাঁধ থেকে ফেলে দিয়ে আছঁড় লাগায়। কখনো ভয় মাটিতে নামিয়ে রেখে চোখের পানি ফেলে...
আহ... আজ যদি আমার বড় ভাইজান তার শতব্যস্থতা থেকে একটু সময় ফারেগ করে আমার সাথে থাকতেন। বাবার নির্দেশ মানতে গিয়ে, যে দামী আমানত আমি কাঁধে নিয়েছি, আমি তো তা বহন করার সামান্যতম যোগ্যতাও রাখি না। ভাইজান সাথে থাকলে, আমি কখনো ভয় পেতাম না কিছুতেই। সাহস হারা হতাম না। উনার চেনা পথ ছিল, তাই কখনো পথ হারাতাম না। একটু সাহায্য করলে, আমি অভয় পেতাম। এই দামী জিনিসে কোন আঁছড় লাগাতাম না।
ভুল পথে চললে, ভুল পথে হাটলে, তিনি সঠিক পথ হাত ধরে দেখিয়ে দিতেন। মহব্বত করে আগে আগে রাহবারি করতেন। কিমতি ওজনদার জিনিসটি আমি ছোট মানুষের কাঁধে না রেখে, নিজের কাঁধে তুলে নিতেন। যতন করে মহব্বতের সাথে তা বহন করতেন। তার যোগ্যতার ফলে কোন আঁছর বা দাগ না লাগিয়ে আরো অনেক আগেই মন্জিলি এই কিমতি আমানত নিয়ে যর্থাথভাবে আমরা পৌছে যেতাম।
মিয়জী মুসা এই ঘটনা বলে চোঁখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, হয়রতগন -
বাবা হলেনঃ জনাবে মোহাম্মদ সালল্লাহু আলাইহি ওয়াসসাললাম।
কিমতি আমানতঃ দাওয়াত ও তাবলীগের এই মোবারক মেহনত।
বড়ভাইঃ ওরাসাতুল আম্বিয়া হয়রত উলামায়ে কেরামগন।
ছোট ভাইঃ আমাদের মতো আওয়াম গণ্ডমূর্খ সাধারন মানুষ। যারা তাবলীগ করতে গিয়ে বাবার এই মহা মূল্যবান আমানত কাধে নিয়ে একাজকে নষ্ট করছি।
বাবার মেইল ফ্যক্টরি, ব্যবসা, বানিজ্য সংসার যা বড় ভাইরা চালাচ্ছেন তা হলো এই মসজিদ, মক্তব, খানকা, মাদরাসা, ওয়াজ নসিহত, তাসনিফাত জেহাদ ও সিয়াসত ইত্যাদি...
আর এই কিমতি আমানত পৌছে দেয়ার মন্জিল হলঃ কেয়ামত পর্যন্ত আনেওয়ালা সমস্ত উম্মত।
এই বয়ানের পর দারুল উলুম দেওবন্দে কান্নার রোল পড়ে গিয়েছিল। বড় বড় শায়খুল হাদীস আর শায়েখ গন হাউমাউ করে কাঁদতে থাকলেন।
আজ হযরত মিয়াজি মুসা রহ. এর সেই ঐতাহাসিক বয়ানটি বড় মনে পড়ছে, এই বয়ান আমাদের (উলামাদের) পথ দেখাতে পারে।
হে আল্লাহ, এই মোবারক দ্বীনের মেহনতের জন্য আমাদের কবুল কর। যারা এই মেহনতেরর হক আদায় না করে, বুকে আগলিয়ে না নিয়ে কেবল ফেৎনা ছড়ায় তাদের হেদায়ত দান কর। আমিন
0 Comments:
একটা ভাল মন্তব্য আমাদের আরও ভাল কিছু লিখার অনুপেরনা যাগাই!